তৎসম

তৎসম  বাংলা ভাষায় ব্যবহূত  সংস্কৃত শব্দ। ‘তৎ’ মানে তার অর্থাৎ সংস্কৃতের এবং ‘সম’ মানে তুল্য। অতএব যে শব্দগুলি কোনো রকম পরিবর্তন ছাড়াই বাংলা ভাষায় ব্যবহূত হয় সেগুলিই তৎসম শব্দ। এ অর্থে ‘তৎসম’ শব্দের প্রথম প্রয়োগ দেখা যায় দন্ডীর (আনু. ৮ম শতকের প্রথমভাগ) কাব্যাদর্শে। তিনি  প্রাকৃত ভাষার উল্লেখ প্রসঙ্গে যেব শব্দ সংস্কৃত ও প্রাকৃত উভয় ভাষায় একই রকম সেগুলিকে বলেছেন তৎসম। বাংলা ভাষায় তৎসম শব্দের প্রচুর ব্যবহার আছে।

প্রাক্ আর্যযুগে বাংলার আদি অধিবাসীদের ভাষার কিছু কিছু শব্দ বাংলা ভাষায় অনুপ্রবেশ করে, যেগুলিকে বলা হয় দেশি শব্দ, যেমন: পেট, ডোঙ্গা, ঢিল, কুলা ইত্যাদি। আর বৈদিক ও সংস্কৃত থেকে প্রাকৃতের মাধ্যমে যে শব্দগুলি অনুপ্রবেশ করে সেগুলিই খাঁটি বাংলা শব্দ। সমাজের নিম্নশ্রেণীর লোকেরা এগুলি ব্যবহার করত, কিন্তু দশম শতকের পূর্ব পর্যন্ত সাহিত্যে এগুলি ব্যবহূত হতো না। মধ্যযুগে এ ভাষায় এক বিশাল সাহিত্য সৃষ্ট হলেও আধুনিক যুগের লেখকরা বাংলা ভাষার সীমিত শব্দসম্ভার নিয়ে কাব্যচর্চায় সাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি। তাঁরা সংস্কৃত থেকে প্রয়োজনীয় শব্দ নিয়ে বাংলায় কাব্যচর্চা করেন। কারণ, প্রাচীনকাল থেকে সংস্কৃত ছিল এদেশের ধর্ম,  দর্শন ও সাহিত্যের বাহন এবং এ ভাষার শব্দগুলি গুরুগম্ভীর ভাব প্রকাশের উপযোগী।

উনিশ শতকের শুরুতে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে যখন বাংলা পড়ানো শুরু হয়, তখন সংস্কৃত পন্ডিতদের দ্বারা উপযুক্ত পাঠ্য পুস্তক লেখানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এর ফলে প্রচুর তৎসম শব্দ বাংলা ভাষায় অনুপ্রবেশ করে এবং ক্রমশই এর সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে সাধু বাংলায় তৎসম শব্দের সংখ্যা ৭০ ভাগেরও বেশি এবং চলিত বাংলায় শতকরা ৪০-৪৫টি। একজন প্রতিষ্ঠিত লেখকের রচনার শতকরা ২৫টি শব্দই তৎসম। যাঁদের রচনার মাধ্যমে তৎসম শব্দ ব্যাপকভাবে বাংলা ভাষায় প্রবেশ লাভ করে তাঁরা হলেন  রামরাম বসু, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরমৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, মাইকেল মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র  চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দের এ ব্যবহার-প্রক্রিয়াকে কেউ কেউ ‘সংস্কৃতায়ন’ বলে অভিহিত করেন।

বাংলা ভাষায় ব্যবহূত তৎসম শব্দগুলিকে দুভাগে ভাগ করা যায়: সমোচ্চারিত ও অসমোচ্চারিত। প্রথম শ্রেণির শব্দগুলি হুবহু সংস্কৃতের মতো লিখিত ও উচ্চারিত হয়, যেমন: নারী, নদী, ভ্রাতা, বধূ ইত্যাদি। আর দ্বিতীয় শ্রেণির শব্দগুলি সংস্কৃত অনুযায়ী লিখিত হলেও উচ্চারণে কিছুটা পার্থক্য ঘটে, যেমন: বৃক্ষ, পদ্ম, ভস্ম ইত্যাদি। এছাড়া আরও কিছু সংস্কৃত শব্দ সামান্য বিকৃতভাবে বাংলায় ব্যবহূত হয়, যেগুলিকে বলা হয় অর্ধতৎসম শব্দ, যেমন: চন্দর< চন্দ্র, বাদ্যি < বাদ্য, মিষ্টি <মিষ্ট, সত্যি < সত্য ইত্যাদি।  [দুলাল ভৌমিক]