তোমে পিরে

তোমে পিরে (১৪৬৫-১৫৪০)  প্রিন্স আফোনসোর (১৪৭৫-১৪৯১) ঔষধ প্রস্ততকারী এবং প্রাচ্যের প্রাচীনতম ব্যাপক বিবরণী Suma Oriental (An account of the East, from the Red sea to China, written in malacca and India in 1512-1515) গ্রন্থের লেখক। পর্তুগালের রাজা দ্বিতীয় জনের (১৪৫৫-৯৫) একজন ঔষধ প্রস্ত্ততকারীর পুত্র তোমে পিরে আনুমানিক ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৫১১ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে রাজার সুপারিশে ভারতের কোচিনে ঔষধ সংক্রান্ত কুঠির অধিকর্তা হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। তিনি ৪,০০০-৫,০০০ রিয়াই (reais) মূল্যমানের ঔষধ সরবরাহের (বটিকা) দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তোমে পিরে-র পরবর্তী নিয়োগ ছিল পর্তুগিজদের নতুন দখলকৃত মালাক্কা এবং জাভায় বাণিজ্যিক বহরের করণিক ও হিসাবরক্ষক হিসেবে। অবশেষে পিরে চীনে প্রথম পর্তুগিজ রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োজিত হন। আলাপ-আলোচনায় কৌশলি হওয়া সত্ত্বেও চীনের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তার সম্পর্ক তিক্ততায় পরিণত হয়। তিনি কারারুদ্ধ হন এবং তাকে চীনের উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ কিয়াংসুতে নির্বাসন দেওয়া হয়। এখানে তিনি সম্ভবত ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। চীনের ওপর লিখিত তাঁর গ্রন্থটি তিনি ভারতের পর্তুগিজ ভাইসরয়কে উপহার দেন এবং বর্তমানে এ গ্রন্থ প্যারিসের জাতীয় আইন সভা (ন্যাশনাল অ্যাসেম্বেলি) পাঠাগারে সংরক্ষিত।

ভারতে আসার পর হতে মৃত্যু পর্যন্ত তোমে পিরে-র জীবন সম্পর্কে তথ্যাদি অনেকটাই অসম্পূর্ণ। তাঁর সম্বন্ধে যতটুকু জানা যায় তা পাওয়া যায় তার বিবরণ, তার ৪টি চিঠি, তার স্বাক্ষরিত ৫টি দলিল এবং তার সম্পর্কে উল্লিখিত কিছু সমসাময়িক দলিলপত্র এবং প্রাথমিক কালানুক্রমিক ঘটনাপঞ্জিতে। সাহিত্যিক শৈলীর দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও একজন উৎসাহী পর্যবেক্ষক এবং তীক্ষ্ণ ও যথার্থ বর্ণনাকারী হিসেবে তোমে পিরে প্রাচ্যের প্রাথমিক ইউরোপীয় লেখকদের মধ্যে একটি স্মরণীয় স্থান দখল করে আছেন।

তোমে পিরে কখনও বাংলায় আসেন নি। কিন্তু ভারত ও মালাক্কায় কর্মরত থাকাকালে লিখিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ সুমা ওরিয়েন্টাল-এর তৃতীয় অংশে সমসাময়িক বাংলার একটি মূল্যবান বিবরণ দিয়েছেন। পিরে-র গ্রন্থে প্রধানত ভারতীয় এবং উত্তরপূর্ব এশিয়ার বন্দরগুলির মধ্যে বাণিজ্যিক কার্যকলাপ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যাহোক, তার পর্যবেক্ষণের তীক্ষ্ণ ক্ষমতা এবং বিশদ বর্ণনায় আগ্রহ, প্রাচ্যদেশীয় পর্যটক, জাহাজের চালক এবং ব্যবসায়ীদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ তার লেখার ওপর প্রভাব ফেলেছিল। এমনকি তিনি যেখানে কখনও ছিলেন না, সেস্থানগুলি সম্পর্কেও তার লেখা থেকে যথেষ্ট ধারণা করা যায়। বস্ত্তত, বহু দূরত্বের সামুদ্রিক বাণিজ্যের অবয়ব তোমে পিরে-কে বাংলার অবস্থা সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দিয়েছে। ষোল শতকে পর্তুগিজ বাণিজ্যিক কার্যকলাপ উপকূলবর্তী এলাকা ও সামুদ্রিক বাণিজ্যের মধ্যে আন্তঃসংযুক্তিকরণের উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়েছিল। করমন্ডল, বা মালাবার অথবা বাংলার বন্দরগুলি বাণিজ্যিক কার্যকলাপে স্বয়ম্ভর ছিল না, বরং রপ্তানি ও আমদানিকৃত পণ্যসামগ্রীকে সঞ্চালিত, সংগ্রহ এবং বণ্টন করতে হতো। শুধু এর কিছু অংশ উপরোক্ত বন্দরগুলির চারপার্শ্বস্থ অঞ্চলে আনা ও ব্যবহার করা হতো। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, লবণাক্ত জলাভূমির মধ্যে অবস্থিত মসুলিপট্টমের বন্দরে খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য সামগ্রীর অভাব ছিল বলে এ বন্দরকে বাংলা থেকে বার্ষিক সরবরাহের উপর নির্ভর করতে হতো। সরবরাহকৃত সামগ্রীর মধ্যে থাকত চাল, ছোলা, মরিচ, আফিম, পাস্ত্তরিত মাখন, এমনকি পাটনার যবক্ষার। এছাড়াও বছরে অন্ততপক্ষে একবার এক জাঙ্ক (চেপটা তলদেশযুক্ত জাহাজ) পূর্ণ সাদা মসৃণ কাপড়, নকশাকৃত বিছানার চাদর, বিভিন্ন প্রকারের মিষ্টান্ন দ্রব্য প্রভৃতি মালাক্কার দিকে যেত। এখানে বাংলার কাপড়ের জন্য বিশেষ চাহিদা ছিল। এ পরিস্থিতিতে, বাংলার ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে পিরে-র পরিচিত হওয়ার সুযোগ ছিল।

একারণে পিরে-র বিবরণে পনেরো শতকের শেষার্ধে বাংলার অরাজকতাপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থার বিশদ বর্ণনা দেখা যায়। আবিসিনিয়ার দাসদের স্বেচ্ছাচারিতা, যাদের অনেকেই ছিল খোজা, এবং শেষ পর্যন্ত তাদের বাংলার সিংহাসন দখল ও দিল্লি সালতানাতকে অস্বীকার করে এ মুসলিম রাজ্যের স্বাধীন হিসেবে টিকে থাকা এ সবই বিশ্লেষণমূলক মন্তব্যসহ তাঁর গ্রন্থে স্থান পেয়েছিল। এ গ্রন্থে প্রতিবেশী উড়িষ্যা ও ত্রিপুরার হিন্দু রাজ্যসমূহের সাথে বাংলার শত্রুতামূলক সম্পর্কের কথারও উল্লেখ রয়েছে। বাংলার তৎকালীন রাজধানীর অবস্থান, অধিবাসী ও তাদের বাসভবনসহ রাজধানীর বর্ণনায় পিরে-র পর্যবেক্ষণের তীক্ষ্ণ ক্ষমতা এবং বিস্তারিত বর্ণনার প্রতি তার আগ্রহ প্রকাশ পায়। বাণিজ্যিক কর্মকান্ড, বণিক সম্প্রদায়ের ও তাদের প্রকৃতির জন্য খ্যাত অভ্যন্তরীণ বন্দরগুলি সম্পর্কে তার বর্ণনা প্রাক্-মুগল বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাস পুনর্গঠনের জন্য এখনও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত। তবে, বাংলার ব্যবসায়ীদের অসততা সম্পর্কে তার পর্যবেক্ষণ পরীক্ষা করে দেখার দাবি রাখে। বাংলার ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে তিনি ‘প্রবঞ্চক’ অভিধা প্রয়োগ করেছেন, তবে এর একটি ব্যাখ্যাও রয়েছে। বিরাজমান এশীয় বাণিজ্যিক ধারার দুর্বলতার মধ্যে বেশির ভাগ ফেরিওয়ালাই ছোট পণ্যবাহী জাহাজ, অল্প মূলধন, প্রত্যেকে নিজস্ব মুদ্রা, যার যার নিজস্ব বাটখারা ও পরিমাপক নিয়ে সামুদ্রিক বাণিজ্যে অংশ গ্রহণ করত। এ পরিস্থিতির সাথে ইউরোপীয়গণ পরিচিত ছিল না। তাই বাংলার বণিকদের কার্যকলাপ পিরে-র নিকট অস্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিল।

পিরে-র সুমা ওরিয়েন্টাল-এর বাংলা অংশের সবকিছু অক্ষরে অক্ষরে গ্রহণ করার পূর্বে এটি মনে রাখতে হবে যে, পিরে-র অসাধারণ গ্রন্থটি হারিয়ে গিয়েছিল এবং বহুদিন কালের গর্ভে ডুবেছিল। ১৯৪৪ সালে হ্যাকলুয়াট সোসাইটি (Hakluyat Society) কর্তৃক সুমা ওরিয়েন্টাল-এর যে অনুবাদ প্রকাশ হয় তা তার লিখিত মূল কপি নয় এবং নকলনবিশ তার অসাবধানতার অনেক প্রমাণই রেখেছেন। বিশৃঙ্খল উচ্চারণসহ পিরে-র অস্পষ্ট শৈলীর কারণে সমগ্র গ্রন্থটির সঠিক ব্যাখ্যা করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। কখনও কখনও অনুবাদককে অনুমানের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে।  [শিরীন আখতার]

গ্রন্থপঞ্জি  Armando Cortesao (tr.), The Suma Oriental of Tome Pires, London, 1944, Reprinted in 1967; Irfan Habib, ‘Merchant Communities in Precolonial India’ in JD Tracy, ed, The Rise of Merchant Empires, Cambridge, 1990; MR Tarafdar, ‘Bengal Economy Viewed in the Light of Tome Pires’ Observations’, Journal of the Asiatic Society of Bangladesh, 40, II.