জ্ঞানদাস

জ্ঞানদাস (ষোল’শ শতক)  চৈতন্যোত্তর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। বৈষ্ণব সাধকদের মধ্যেও তিনি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কাটোয়ার কাঁদড়া গ্রামে এক মঙ্গল-ব্রাহ্মণ বংশে তাঁর জন্ম। এজন্য তিনি মঙ্গল ঠাকুর, শ্রীমঙ্গল, মদন-মঙ্গল প্রভৃতি নামেও পরিচিত ছিলেন।

জ্ঞানদাস নিত্যানন্দের ভাবশিষ্য এবং তাঁর পত্নী বৈষ্ণব সমাজের নেত্রীস্থানীয় জাহ্নবীদেবীর মন্ত্রশিষ্য ছিলেন। বৃন্দাবনে তিনি শ্রীজীব, রঘুনাথদাস, গোপাল ভট্ট,  কৃষ্ণদাস কবিরাজ প্রমুখ বৈষ্ণব সাধক ও পন্ডিতদের সান্নিধ্য লাভ করেন। জ্ঞানদাসই প্রথম ‘ষোড়শ-গোপাল’-এর রূপ বর্ণনা করে পদ রচনা করেন। তিনি বাংলা এবং ব্রজবুলিতে রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক প্রায় দুশ (মতান্তরে চারশ) পদ রচনা করেন। তাঁর রচিত মাথুর ও মুরলীশিক্ষা বৈষ্ণবগীতিকাব্যের দুটি মূল্যবান গ্রন্থ। তিনি একজন সঙ্গীতজ্ঞও ছিলেন এবং কীর্তনের নতুন পদ্ধতির স্রষ্টা হিসেবে তাঁর বিশেষ খ্যাতি ছিল।

জ্ঞানদাস পদ রচনার ক্ষেত্রে মধ্যযুগের গতানুগতিক ধারা পরিহার করে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক অর্থাৎ রাধাকৃষ্ণের রূপাশ্রয়ে ভক্ত-ভগবানের আধ্যাত্মিক লীলা বর্ণনা করেন। পদরচনায় তিনি  বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাসকে অনুসরণ করলেও সংস্কার ত্যাগ করে নিজের মতো করে সরল সুরে পদ রচনা করেন, যে কারণে পাঠক সহজেই তাঁর লেখায় আকৃষ্ট হয়। প্রেম, সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মিকতা জ্ঞানদাসের রচনার মুখ্য বিষয়। বৃন্দাবনের কিশোর-কিশোরীর  লীলাকে জ্ঞানদাস মানবজীবনের আলোকে বর্ণনা করেছেন। ধর্মীয় সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে তিনি প্রেমবিরহের অনুভূতির কথা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বিদ্যাপতির আলঙ্কারিক রীতি পরিত্যাগ করে  চন্ডীদাস ও নরহরি সরকারের সহজ, সরল ও মরমী রীতিতে পদ রচনা করেছেন। আবেগের গভীরতা এবং অনুরাগের আধিক্য তাঁর পদে বেশি লক্ষ করা যায়।

জ্ঞানদাস বাংলা ভাষাকে ভাব প্রকাশের উপযুক্ত বাহন করতে পেরেছিলেন। রচনার মধ্য দিয়ে তিনি শব্দচিত্র ও ধ্বনিচিত্র এ দুয়ের রূপায়ণে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। বৈষ্ণবদের মধ্যে তিনিই প্রথম সার্থকভাবে দেহ ও মন, রূপ ও স্বরূপের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করেন। পূর্বরাগ বর্ণনায় জ্ঞানদাসের কবিকণ্ঠ ছিল মুখর। রাধার হূদয়াকুতি জ্ঞানদাস যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা একমাত্র চন্ডীদাস ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি। বৈষ্ণবসাহিত্যে জ্ঞানদাসের অবদান অপরিসীম। [মোঃ মাসুদ পারভেজ]