জোয়ারভাটা খাত

জোয়ারভাটা খাত (Tidal Channel)  জোয়ারভাটার প্রভাবে জলপৃষ্ঠ (water level) পর্যায়ক্রমিক ওঠানামা করে নদনদীর এমন অংশ। পৃথিবীর আবর্তন এবং সেই সঙ্গে চন্দ্র, সূর্য ও পৃথিবীর পারস্পরিক মহাকর্ষের টানে প্রতিদিন দুই বার (প্রায় ১২ ঘণ্টা অন্তর অন্তর) সাগর, মহাসাগর, উপসাগর, নদনদী ও অন্যান্য জলরাশির পানি নিয়মিত ও পর্যায়ক্রমে স্ফীত হয়ে ওঠে এবং নেমে যায়। জলরাশির পর্যায়ক্রমে ওঠানামাকে মহাকর্ষীয় জোয়ারভাটা বা শুধু জোয়ারভাটা বলে। জোয়ারভাটা প্রধানত গভীর সমুদ্রে উৎপন্ন হয় এবং সেখান থেকে তা উপকূলীয় জলরাশিতে ছড়িয়ে পড়ে।

জোয়ারভাটা নদীখাতে দ্বিমুখী প্রবাহের সৃষ্টি হয়। জোয়ারের প্রভাবে জোয়ারভাটা খাতের মধ্য দিয়ে উজানে স্রোত বিস্তৃত হলে তাকে প্লাবন জোয়ার (flood tide) বা শুধু জোয়ার বলা হয়, আবার যখন তা ভাটিতে উল্টো প্রবাহিত হয়ে সাগরমুখী হয় তখন তাকে ভাটা (ebb tide) বলা হয়। জলস্তরের পর্যায়ক্রমিক ওঠানামার ফলে জোয়ারের সময় অস্থায়ী জলসঞ্চয়ন ঘটে এবং ভাটার সময় তা আবার নিষ্কাশিত হয়ে যায়। প্লাবন জোয়ারের সময় সমুদ্রের পানি নদীখাতের জোয়ারভাটা সীমা (tidal limit) পর্যন্ত অনুপ্রবেশ করে। নদীখাতে এভাবে লবণাক্ত পানি প্রবেশের ফলে লবণাক্ত ও স্বাদুপানির সংমিশ্রণ ঘটে। জোয়ারভাটা কত দূরত্ব পর্যন্ত অনুভূত হবে তা নির্ভর করে নদীর ঢাল (slope), জোয়ারভাটার পরিসর (tidal range), স্বাদুপানি প্রবাহের পরিমাণ, নদীর গঠন প্রভৃতির ওপর। মরা কটাল (neap tide) বা নদীর উচ্চ প্রবাহকালীন অবস্থায় স্বাদু ও লবণাক্ত পানির মিলিত প্রবাহ সাগরমুখী স্থানান্তরিত হয় এবং তেজ কটাল বা ভরা কটাল (spring tide) বা নদীর নিম্ন প্রবাহকালীন (low river discharge) অবস্থায় স্বাদু ও লবণাক্ত পানির মিলিত স্রোত উজানের দিকে প্রবাহিত হয়। এভাবে জোয়ারভাটা খাতসমূহ ভাঙন ও পরিবৃদ্ধি উভয় প্রকার পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। জোয়ারভাটা খাত সর্পিলাকৃতি কিংবা বিনুনি- উভয় আকৃতির হতে পারে।

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল বহুসংখ্যক বৃহৎ জোয়ারভাটা খাত দ্বারা বিভক্ত যেগুলি বঙ্গোপসাগরে জল প্রবাহিত করছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট জোয়ারভাটা প্রধানত অর্ধ-আহ্নিক অর্থাৎ প্রতিদিন দুইবার জোয়ার এবং দুইবার ভাটা সংঘটিত হয় যাদের স্থায়িত্বকাল ১২ ঘণ্টা করে। জোয়ারভাটা সৃষ্ট তরঙ্গের গতিবেগ যা জোয়ারভাটা খাতের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয় তা নির্ভর করে নদীখাতের প্রস্থচ্ছেদ এলাকা এবং সেই সঙ্গে আশপাশের নদীসমূহের পানির স্তরের ওপর। অতঃপর তা এক  নদীখাত থেকে অন্য নদীখাতে প্রবাহিত হয়। জোয়ার-ভাটার এ খেলা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে খুবই পরিচিত। এক নদীর জোয়ারভাটা সৃষ্ট তরঙ্গের সঙ্গে আরেকটি নদী থেকে আগত জোয়ারভাটা তরঙ্গ মিলিত হয়, আর এ মিলন বিন্দুকে জোয়ারভাটা মিলন বিন্দু (tidal meeting point) বলা হয়। জোয়ারভাটা মিলন বিন্দুসমূহে জোয়ারভাটা সময়কালে প্রবাহ স্থির অথবা নিম্ন হয়ে থাকে যার পরিণতিতে সেখানে  পলি সঞ্চয়ন ঘটে। জোয়ারভাটা মিলনবিন্দু অনুপস্থিত থাকলে জোয়ারভাটার প্রবাহ চলন্ত থাকে এবং পলি সঞ্চয়ন খুবই কম হয়। জোয়ারভাটা খাত নদীতে যান চলাচলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বর্ষাকালে এই খাতগুলোর পরিধি বৃদ্ধি পায় এবং শীতকালে তা কমে আসে।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ভূ-অভ্যন্তরভাগে বর্ষাঋতুতে ২২৫ কিমি এবং শুষ্কঋতুতে ৩২৫ কিমি পর্যন্ত জোয়ারভাটার ক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। জোয়ারভাটার গড় উল্লম্ব পরিসর স্থানভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে এবং খুলনার হিরণ পয়েন্ট (পসুর নদীতে অবস্থিত) উপকূলে পরিসর প্রায় ৩মি এবং ভূ-অভ্যন্তরভাগের ২৭৫ কিমি দূরত্বে এ পরিমাপ প্রায় ০.৫মি। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান জোয়ারভাটা খাতসমূহ হচ্ছে- লোয়ার মেঘনা (Lower Meghna River), শাহবাজপুর চ্যানেল, হাতিয়া চ্যানেল, সন্দ্বীপ চ্যানেল, রায়মঙ্গল নদী, মালঞ্চ নদী, শিবসা নদী, পসুর নদী, বলেশ্বর নদী, কর্ণফুলি নদী, সাঙ্গু নদী, মাতামুহুরী নদী, বাকখালী নদী প্রভৃতি।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বি.আই.ডব্লিউ.টি.এ) জোয়ারভাটা প্রভাবিত নদীগুলি সম্পর্কে উপাত্ত সংগ্রহ ও প্রকাশ করে থাকে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বি.ডব্লিউ.ডি.বি)-ও নির্দিষ্ট কয়েকটি স্টেশনে জোয়ারভাটা খাতগুলির বিষয়ে উপাত্ত সংগ্রহ করে থাকে।  [এইচ.এস মোজাদ্দাদ ফারুক]

আরও দেখুন নদীখাত

মানচিত্রের জন্য দেখুন উপকূলবর্তী দ্বীপ