জৈবিক অস্ত্র

জৈবিক অস্ত্র (Biological Weapon) মানুষ, প্রাণী বা উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকর কোনো জৈবিক পদার্থ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে যুদ্ধের কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হলে তাকে জৈবিক অস্ত্র নামে আখ্যায়িত করা হয়। জৈবিক অস্ত্রসমূহ: জৈবিক বিষ (যেমন: বোটুলিনাম, রিসিনেট), ব্যাকটেরিয়া (যেমন প্লেগ, অ্যানথ্রাক্স বা কিউ জ্বর) বা ভাইরাস (গুটিবসন্ত, হেপাটাইটিস ইত্যাদি) এর মতো সংক্রামক জীবাণু হতে পারে। জৈবিক অস্ত্রকে কখনো জীবাণু যুদ্ধাস্ত্র নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। অদ্যাবধি ১৮০টিরও অধিক রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু জৈবিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। জৈবিক যুদ্ধ সাধারণ পারমাণবিক যুদ্ধ বা রাসায়নিক যুদ্ধ অথবা অন্যান্য ধরনের বিধ্বংসী সমরাস্ত্র জড়িত যুদ্ধ থেকে আলাদা। জৈবিক অস্ত্রগুলো প্রাণঘাতী বা অ-মারাত্মক হতে পারে এবং একটি গোষ্ঠি, এমনকি সমগ্র জনসংখ্যার ধ্বংসের কারণ হওয়ার সক্ষমতা রাখে। প্রাণঘাতী জৈবিক অস্ত্র দ্বারা গণহত্যা সম্ভব, কিন্তু এগুলো বিল্ডিং, অবকাঠামো, বা সরঞ্জামের ব্যাপক ধ্বংস ঘটাতে অক্ষম। জৈব অস্ত্র ব্যবহারের ফলাফল এর প্রস্তুতির পদ্ধতি, পরিবেশে এর স্থায়িত্ব এবং সংক্রমণের ধরণের ওপর নির্ভর করে স্বল্প থেকে গুরুতর পর্যন্ত হতে পারে। এগুলো জৈব সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা জাতি, রাজ্য বা অ-জাতীয় গোষ্ঠীর ওপর হামলা চালাতে তৈরি, মজুত বা স্থাপিত হয়ে থাকে এবং এরোসল স্প্রে, খাবার/পানীয়, বিস্ফোরক যন্ত্র এবং ত্বকীয় শোষণ বা ইনজেকশনের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

জৈবিক অস্ত্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো (১) দক্ষতা, কারণ বোটুলিনাম টক্সিনের এক ফোঁটা সমপরিমাণ জীবাণু একটি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে যথেষ্ট; (২) সাশ্রয়ী, রাসায়নিক এবং পারমাণবিক অস্ত্রের তুলনায় জৈবিক অস্ত্রগুলো সস্তা, কারণ প্রয়োজন অনুসারে ল্যাবে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সহজেই জন্মানো যায়; (৩) সহজে স্থানান্তরযোগ্য, এমনকি ডাকযোগে প্রেরণও সম্ভব; যা ২০০১ সালে অ্যানথ্রাক্স আক্রমণের সময় করা হয়েছিল এবং এক্ষেত্রে আক্রমণকারী তার সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রাখতে সক্ষম হয়; (৪) অনুমান অযোগ্য, যেমন বায়ু বাহিত বিষাক্ত পদার্থের ক্ষেত্রে তা কোনো এলাকায় বাহিত হবে তা নির্দিষ্ট করে অনুমান করা যায় না, জীবাণু অস্ত্রের গতিবিধি ও অনির্ণেয়; এমনকি নিজের সৈন্যরাও সংক্রমিত হতে পারে; (৫) দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব, অ্যানথ্রাক্স প্রায় ৫০ বছর মাটিতে অবস্থান করতে পারে যা ভবিষ্যতে সংস্পর্শে আসা জীবকে অবাঞ্ছিতভাবে সংক্রমিত করতে পারে; (৬) কার্যকারিতা, জৈবিক অস্ত্রের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য ক্রমাগত গবেষণা চালাতে হয়।

কিছু সম্ভাব্য জৈবিক অস্ত্র হলো (১) অ্যানথ্রাক্স ব্যাকটেরিয়া যা ইনহেলেশন সেপ্টিসেমিয়া, ফ্লুর মতো উপসর্গ সৃষ্টি করে; (২) দুষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে ক্লোস্ট্রিডিয়াম বোটুলিনাম স্নায়বিক জটিলতা সৃষ্টি করে যা আক্রান্ত ব্যক্তিকে পক্ষাঘাতের দিকে ধাবিত করে; (৩) উন্মুক্ত ক্ষতের মাধ্যমে ক্লোস্ট্রিডিয়াম পারফ্রিনজেন নামক জীবাণু গ্যাস গ্যাংগ্রিন সৃষ্টি করে, পেটে তীব্র অস্বস্তির উদ্রেক করে; (৪) গুটিবসন্তের ভাইরাস দূষিত বস্তুর সাথে সরাসরি মিশে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ক্রমাগত জ্বর ও শরীরে ফুসকুড়ি সৃষ্টি করে; (৫) রাইসিন,ক্যাস্টর বীজ হতে প্রাপ্ত প্রোটিন টক্সিন যা দূষিত খাবার বা জলের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে তীব্র পেটে ব্যথা, রক্তাক্ত ডায়রিয়া এবং পালমোনারি এডিমা ঘটায়।

যুদ্ধে জৈব অস্ত্রের ব্যবহার রোধ করার জন্য বিভিন্ন জাতি সম্মিলিতভাবে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলো। জেনেভা প্রোটোকল নামে একটি চুক্তি ১৯২৫ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল যাতে যুদ্ধের সময় কোনো জৈবিক পদার্থ এবং শ্বাসরোধকারী, বিষাক্ত বা অন্যান্য গ্যাস ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। পঞ্চাশ বছর পরে জৈবিক অস্ত্র কনভেনশন ১৯৭৫ সালে জৈবিক অস্ত্রের বিকাশ, উৎপাদন, অধিগ্রহণ, স্থানান্তর, মজুদ এবং ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। বর্তমানে জৈব অস্ত্রের ব্যবহারকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। [মো. জসিম উদ্দিন]