জেনানা মিশন

জেনানা মিশন  বাঙালি ও ভারতীয়দের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিতকরণের লক্ষ্যে ব্রিটেনে প্রতিষ্ঠিত একটি আন্দোলন। এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল জেনানা অর্থাৎ অন্তপুরে গিয়ে নারী কর্তৃক নারীদের পাশ্চাত্য শিক্ষা দেওয়া এবং ওই শিক্ষার মাধ্যমে নারীর সনাতন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটানো। বাংলা ও ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাঠদান এবং পরিশেষে নারীদেরকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করাই ছিল জেনানা মিশনের মুখ্য উদ্দেশ্য। পাঠ্যবিষয় করা হয় প্রধানত পাশ্চাত্যের প্রাচ্যধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার প্রথা যা পাশ্চাত্য দৃষ্টিতে ভ্রান্ত ও কুসংস্কার ছিল। নারীদের মধ্যে এতদ্দেশীয় ধর্ম ও আচার প্রথার বিরুদ্ধে মনোভাব গঠন করা ছিল জেনানা মিশনের স্ত্রীশিক্ষা কর্মসূচীর অঘোষিত উদ্দেশ্য।

জেনানা একটি ফার্সি শব্দ যার অর্থ ’নারী’। শব্দটি দ্বারা কোন বাড়ির একটি নির্দিষ্ট অংশকেও বোঝায় যা কেবলমাত্র নারীদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত থাকে।জেনানা বা জেনানামহল শব্দদ্বয় একে অপরের সম্পূরক যা দ্বারা নারী বা নারীর আবাসস্থল উভয়কেই নির্দেশ করে। উচ্চবংশীয় মুসলিম এবং হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে নারীর প্রতি উচ্চ মর্যাদা প্রদর্শনে এরূপ পৃথক ব্যবস্থা করাকে গর্বের বিষয় হিসেবে বিবেচিত হত। এ ধরণের পরিবারের মেয়েরা মিশনারিদের কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্কুলে আসত না। ফলে মিশনারি সোসাইটি কর্তৃক উচ্চ বংশীয় মেয়েদের মধ্যে ধর্মান্তকরণের কার্যক্রমে সমস্যার সৃষ্টি করছিল। এ ধরণের সমস্যার মোকাবেলায় মিশনারীগণ মেয়েদের বাইরে আনার উদ্যোগ না নিয়ে মিশনারি নারী কর্তৃক জেনানা মহলে যেয়ে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা চালায়, এ আশায় যে তারা তাদের মেয়েদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। এভাবেই মিশরারিদের উদ্যোগে গৃহশিক্ষার পুরনো ঐতিহ্য ‘জেনানা শিক্ষা’ নামে এক নতুন মাত্রা পায়। সঠিক তারিখ না জানা গেলেও ১৮৪০ এর দশকে মিসেস জন শেলীর উদ্যোগে পূর্ব বাংলার যশোর অঞ্চলে প্রথম জেনানা শিক্ষার কার্যক্রম শুরু হয়। এ ধরণের মিশনারী শিক্ষকদের সহযোগিতা করতো স্থানীয় ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান নারীগণ, বিশেষ করে ‘বাইবেল নারী’ নামে পরিচিত নিম্ন শ্রেণীর ধর্মান্তরিত নারীগণ। এভাবে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বঙ্গদেশে নারীশিক্ষা প্রবর্তনের কয়েক যুগ আগে থেকেই মিশনারিরা স্ত্রীশিক্ষার ব্যাপারে এগিয়ে আসে। যদিও তাদের উদ্দেশ্য ছিল ধর্মপ্রচার। অতি অল্প বয়সে মেয়েদের স্কুল পরিত্যাগ করতে হত বলে প্রকৃত শিক্ষার আলো থেকে তারা বঞ্চিত থাকত। তাছাড়া উচ্চ শ্রেণীর মেয়েরা সাধারণত পর্দানশীল এবং তাঁরা বাইরে বের হত না বলে মিশনারিদের প্রতিষ্ঠিত স্কুলে যেতে পারত না। এসব সীমাবদ্ধতার কারণে মিশনারিরা ভদ্র পরিবারের মেয়েদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে পরিকল্পিত পাঠদানের চেষ্টা চালায়।

মেরী জেইন কেনার্ড ছিলেন একজন খ্রিস্টান মিশনারি। ব্রিটিশ সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতায় ১৮৫২ সালে তিনি ’জেনানা মিশন’ নামে নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতে মহিলাদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে জেনানা মিশনই প্রথম ভারতে মহিলা ধর্মপ্রচারক প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। জেনানা মিশন চার্চ মিশনারি সোসাইটি (প্রতিষ্ঠিত. ১৭৯৯ সাল)-এর অঙ্গ সংস্থারূপে ভারতে ধর্মপ্রচার পরিচালনা করে। ১৮৬৪ সালে ভারতে জেনানা মিশনের নতুন নাম হয় Indian Female Normal and Instruction Society। ১৮৮০ সালে ইংল্যান্ডে জেনানা মিশন নতুন কর্মকান্ড হিসেবে পাশ্চাত্য চিকিৎসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং এর সঙ্গে মিশনের নতুন নামও দেওয়া হয় Zenana Bible and Medical Mission।

মিশনারিদের কর্তৃক ১৮৮২ সালের ভারতীয় শিক্ষা কমিশন (হান্টার কমিমন নামে জনপ্রিয়) গঠিত হওয়ায় সরকারি উদ্যোগে জেনানা শিক্ষা বা স্ত্রীশিক্ষা নীতি আরও জোরদার হয়। এতে বলা হয় যে, জেনানা শিক্ষায় নিয়োজিত শিক্ষকগণ সরকারী অনুদান লাভ করবে। অতএব, সরকার মিশনারি প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলিকে অনুদানের আকারে সাহায্য দান করতে শুরু করে। জেনানা মিশনের প্রকল্পিত জেনানা শিক্ষার আদলে বঙ্গদেশের অন্যান্য মিশনারি সংস্থাগুলিও জেনানা মহলে শিক্ষা প্রসারের নামে খ্রিস্টধর্ম প্রচারে উদ্যোগী হয়। ফলে উনিশ শতকের শেষ নাগাদ মহিলা মিশনারিদের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। মিশনারি কর্মকান্ড এমন বেড়ে যায় যে, বিশ শতকের গোড়ায় ভারতে প্রায় চল্লিশটি মিশনারি সংস্থা জেনানা শিক্ষায় নিয়োজিত থাকতে দেখা যায়। জেনানা শিক্ষার মাধ্যমে খ্রিস্টধর্ম প্রচারে লিপ্ত সংস্থাগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য Society for Promoting Female Education in the East (est.1834); Ladies’ Society for Female Education, Free Church of Scotland (est. 1837); Women’s Union Missionary Society (est. 1861); Baptist Female Missionary Society (est. 1870); Ladies’ Committee for Missions in India and China (est. 1875); Church of England Zenana Missionary Society (est. 1880)।

তবে জেনানা শিক্ষার মাধ্যমে খ্রিস্টধর্ম প্রচার প্রচেষ্টা ইপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। অনেক মহিলা জেনানা শিক্ষা গ্রহণ করেছে বটে কিন্তু জেনানা শিক্ষায় তারা ধর্মীয়ভাবে প্রভাবিত হয়নি, খ্রিস্টধর্মও তেমন গ্রহণ করে নি। এ সত্যটি সরকার অনুধাবন করতে পেরে ১৯৩৩ সালে জেনানা শিক্ষায় নিয়োজিত সকল মিশনকে সরকারি অনুদান প্রদান বন্ধ করে দেয় এবং একই সঙ্গে সরকার প্রতিষ্ঠিত জেনানা শিক্ষা ব্যবস্থাও বিলুপ্ত হয়।  [আশা ইসলাম]