চিজ

চিজ (Cheese) বা পনির এক প্রকার দুগ্ধজাত খাদ্য যা ছানাকে বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। চিজ গঠনে দুধে উপস্থিত কেজিন নামক বিশেষ ধরনের আমিষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিক পালন করে। উৎসেচক অথবা এসিডের প্রভাবে দুধকে জমাটবদ্ধ করে প্রাপ্ত ছানাকে পৃথকীকরণের পর বিভিন্ন ধাপে দুধের আমিষ ও চর্বিকে ঘণীভুতকরণের মাধ্যমে চিজ তৈরি করা হয়। চুড়ান্ত ধাপে ছানাকে বিশেষ কিছু অণুজীবের উপস্থিতিতে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় পাকানোর মাধ্যমে প্রত্যেক প্রকারের চিজের বিশেষ স্বাদ, গন্ধ ও গঠন নিশ্চিত করা হয়। চিজ পাকানোর এই প্রক্রিয়াকে রাইপেনিং বলা হয়।

গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি গৃহপালিত পশু থেকে প্রাপ্ত দুধ থেকে চিজ তৈরি হয়। ধারণা করা হয় আজ থেকে প্রায় ৮,০০০ বছর আগে তৎকালীন তাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদের মধ্যবর্তী অঞ্চলে (বর্তমান দক্ষিণ তুরস্ক) চিজের উদ্ভব ঘটে ছিল। বর্তমানে পৃথিবীতে হাজারেরও অধিক প্রকারের চিজ পাওয়া যায় যেগুলি স্বাদে, গন্ধে ও গঠনে অনন্য। এই চিজগুলোর কোন কোনটি তৈরি হতে ২ বছর পর্যন্ত সময়ের প্রয়োজন হয়। তবে অধিকাংশ ধরনের চিজ তৈরিতে কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত সময় লাগে।

গঠনের উপর ভিত্তি করে চিজকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হয়Ñ নরম, অর্ধ-শক্ত, শক্ত ও খুব শক্ত। দুধ জমানোর উপকরণের তারতম্যের উপর ভিত্তি করে চিজ আবার দুই প্রকারÑ রেনেট চিজ ও এসিড চিজ। রেনেট এক বিশেষ প্রকারের উৎসেচক যা সাধারণতঃ দুগ্ধপোষ্য বাছুর বা ছাগল ছানার পাকস্থলী থেকে সংগ্রহ করা হয়। তবে বর্তমানে ব্যাকটিরিয়া থেকে প্রাপ্ত রেনেট সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশ্বে উৎপাদিত ৮০ শতাংশ চিজ রেনেট দিয়ে জমানো দুধ দিয়ে তৈরি করা হয়। রেনেট চিজের মধ্যে চেডার, ইমেনটাল, পারমেজান, মোজারেলা, স্টিলটন, অষ্টগ্রাম চিজ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। রেনেট চিজগুলো সাধারণত ৩ দিন থেকে শুরু করে ৯ মাস, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি সময় ধরে রাইপেনিং করা হয়। বাদবাকি প্রকারের চিজ তৈরি করা হয় গরম দুধে এসিড যোগ করে ছানা কাটার মাধ্যমে। এই প্রকারের চিজগুলো তৈরি করতে মাত্র কয়েক ঘন্টা সময় লাগে, কারণ রাইপেনিং প্রয়োজন হয় না। এসিড চিজের মধ্যে রান্নার পনির, কটেজ চিজ, ক্রীম চিজ, কোয়ার্গ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি প্রক্রিয়াজাতকৃত বিশেষ ধরনের চিজ খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যা রেনেট বা এসিড চিজকে জ্বাল দিয়ে বিশেষ কিছু লবণ সহযোগে তৈরি করা হয়। এই চিজগুলো দীর্ঘ দিন সংরক্ষণ করা যায়। চিজ অত্যন্ত পুষ্টিকর একটি খাদ্য। গঠন সাপেক্ষে চিজে সাধারণভাবে ২০-৩৫% চর্বি, ১৫-২০% আমিষ ও ৪-১২% হারে লবণ থাকে। রাইপেনিং প্রক্রিয়ার মধ্যমে চিজ অত্যন্ত সহজপাচ্য খাবারে পরিণত হয় বিধায় শিশু, রোগী, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী মায়েদের জন্য চিজ একটি আদর্শ খাদ্য। চিজ সাধারণত খাদ্যের একটি পদ হিসেবে সরাসরি খাওয়া হয়। তবে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যের উপকরণ হিসেবেও চিজের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। যেমন, পিজা তৈরিতে মোজারেলা চিজ, বার্গারের সাথে প্রক্রিয়াজাতকৃত চিজ, বেকারি পণ্য তৈরিতে রিকটা চিজের ব্যবহার সমগ্র বিশ্বে সমাদৃত। আবার পনির দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানে বিভিন্ন ধরনের তরকারি যেমন, চানা-পনির, পালক-পনির ইত্যাদি তৈরি করা হয়।

বিশ্বে চিজের উৎপাদন ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। শীর্ষস্থানীয় চিজ উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশেও চিজ দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। দেশের ঠাকুরগাঁও, রংপুর, কিশোরগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায় অনেক ছোট-বড় চিজের কারখানা গড়ে উঠেছে। [রায়হান হাবিব]

আরও দেখুন দুধ, দুগ্ধজাত পণ্য