চিংড়ি
চিংড়ি (Prawn) Decapoda বর্গের কাঁকড়া ও লবস্টারের সমগোত্রীয় খাদ্য হিসেবে ব্যবহার্য এক ধরনের ক্রাস্টেসিয়ান (Crustacean)। পৃথিবী জুড়ে প্রায় সব ধরনের জলাশয়ে এরা বাস করে। কিছু প্রজাতি সমুদ্র উপকূলের কাছে কাদা বা বালির মধ্যে অথবা পাথরের ফাটলে লুকিয়ে বাস করে। অন্যরা দলে দলে গভীর সমুদ্রের ঠান্ডা পানিতে সাঁতার কাটে। এগুলি ধূসর, বাদামি, সাদা বা গোলাপি রঙের। কোনোটির গায়ে ডোরা, কোনোটিতে নানা ধরনের ফুটকি থাকে। কিছু চিংড়ি লাল, হলুদ, সবুজ ও নীল রঙের। কোনো কোনো প্রজাতি পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রয়োজনে রং বদলায়। গভীর সমুদ্রের অনেক চিংড়ি দীপ্যমান (আলোদায়ী)। চিংড়ির আকার সাধারণত ২.৫ সেমি থেকে ৩০ সেমি।
চিংড়ি সর্বভুক এবং বর্জ্যজীবী (scavenger), কোনো কোনোটি প্লাঙ্কটনভোজী। কিছু প্রজাতির স্ত্রী চিংড়ি উদরের নিচে সন্তরণ উপাঙ্গে নিষিক্ত ডিম না ফোটা পর্যন্ত বহন করে। অন্য চিংড়ি পানিতেই নিষিক্ত ডিম পাড়ে। অধিকাংশ প্রজাতিতে ডিম থেকে নপ্লিয়াস লার্ভা বের হয় এবং এটি পরিণত অবস্থায় পৌঁছা পর্যন্ত কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করে। বঙ্গোপসাগর, মোহনা ও স্বাদুপানিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ চিংড়ি থাকায় বাংলাদেশকে চিংড়িসমৃদ্ধ দেশ বলা যায়। এদেশে মোট ৫৬টি প্রজাতির চিংড়ি শনাক্ত করা হয়েছে এবং এগুলির মধ্যে ৩৭টি লবণাক্ত পানির, ১২টি কমলবণাক্ত পানির ও ৭টি স্বাদুপানির বাসিন্দা। চিংড়ি ছয়টি গোত্রভুক্ত, যথা Palaemonidae, Penaeidae, Pandalidae, Alpheidae, Hippolylidae ও Sergestidae। স্বাদুপানির চিংড়ি প্রজাতিগুলি Palaemonidae গোত্রভুক্ত।
সারণি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ চিংড়ির আকার, বাসস্থান ও ডিম পাড়ার মৌসুম।
প্রজাতির নাম | গড় আকার (সেমি) | বাসস্থান | ডিম পাড়ার মৌসুম |
Macrobrachium rosenbergii | পুরুষ: ৩৪.০০; স্ত্রী: ২৬.৭০ | নদী, শাখানদী, খাল ও নদীমুখ | জানুয়ারি-জুলাই |
M. malcolmsonii | পুরুষ: ১৬.৬০; স্ত্রী: ১২.৮০ | নদী, শাখানদী, খাল, নদীমুখ ও প্লাবনভূমি | সারা বছর |
M. rude | পুরুষ: ১২.০০; স্ত্রী: ১০.৫০ | নদীমুখ ও জোয়ারভাটার নদী | জুলাই-নভেম্বর |
Penaeus monodon | পুরুষ: ২৯.৮০; স্ত্রী: ৩০.০০ | বঙ্গোপসাগর ও নদীর মোহনা | নভেম্বর-মার্চ |
P. semisulcatus | পুরুষ: ২০.৪০; স্ত্রী: ২৩.০০ | বঙ্গোপসাগর ও নদীর মোহনা | জানুয়ারি-এপ্রিল |
P. indicus | পুরুষ: ১৫.০০; স্ত্রী: ২৩.০০ | বঙ্গোপসাগর ও নদীর মুখ | অক্টোবর-নভেম্বর, মে-জুন |
P. japonicus | পুরুষ: ১৬.০০ | বাঁশখালী ও সাতক্ষীরার নদীগুলির মুখে | জানুয়ারি-এপ্রিল |
P. merguiensis | পুরুষ: ১৫.৫০; স্ত্রী: ২০.০০ | খুলনা ও পটুয়াখালীর নদীমুখ ও নদীমোহনা | অক্টোবর-জানুয়ারি |
P. penicillatus | পুরুষ: ১৪.৫০; স্ত্রী: ১৬.৬০ | বঙ্গোপসাগর, সুন্দরবন ও পটুয়াখালীর মরা নদী | জানুয়ারি-মার্চ |
P. orientalis | পুরুষ: ১২.২০; স্ত্রী: ১৯.০০ | বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবন | নভেম্বর-মার্চ |
Metapenaeus monoceros | পুরুষ: ১২.৫০; স্ত্রী: ১৫.৫০ | বঙ্গোপসাগর, সুন্দরবন ও নদীমুখ | সারা বছর |
সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে চিংড়ি একটি জনপ্রিয় খাদ্য। দেশে ও বিদেশে চিংড়ির ভালো বাজার রয়েছে। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যসমূহের মধ্যে চিংড়ি অন্যতম। এ থেকে প্রতি বছর আয় হয় বহু কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন, বাংলাদেশ জাতীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থা এবং কতিপয় ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান চিংড়ি সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাত ও রপ্তানি করে। খুলনা, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় কয়েকটি চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে উঠেছে। [সেলিনা পারভিন]
চিংড়ি চাষ আমিষ খাদ্যের অন্যতম উৎস হিসেবে চিংড়ি পালন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন। বাংলাদেশে একসময় বিভিন্ন নদ-নদী, খাল-বিল, উপকূলীয় অগভীর এলাকা ও গভীর সাগর থেকে চিংড়ি সংগ্রহ করে তা বাজারজাত করা হতো। বিশ্ববাজারে এ সম্পদের চাহিদা ও মূল্য বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ চিংড়ি চাষের প্রতি দৃষ্টি দেয়। এটি এখন রপ্তানিমুখী সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত। বর্তমানে এর চাষ ও উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে, যদিও মোট উৎপাদনের সিংহভাগ আহরণ করা হয় প্রাকৃতিক উৎস থেকে।
বর্তমানে দেশে চিংড়ি চাষের জন্য ব্যবহূত খামারের মোট আয়তন ২,১৭,৮৭৭ হেক্টর এবং ২০০৬-০৭ সালে মোট উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১,২৯,১৬০ মে টন। একটি লাভজনক শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় উপকূলীয় এলাকায় চিংড়ি চাষের সম্প্রসারণ ঘটছে এবং খামারের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশে হেক্টর প্রতি চিংড়ির উৎপাদন প্রায় ৫৯২ কেজি। অথচ থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে হেক্টর প্রতি ১,৫০০-৩,০০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদিত হয়।
চিংড়ি চাষ পদ্ধতি বাংলাদেশে প্রথম ১৯২৯-৩০ সালে সুন্দরবন অঞ্চলে চিংড়ি চাষের সূচনা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক উপকূলীয় বন্যা প্রতিরোধ ও পানি নিষ্কাশন বাঁধ তৈরীর পূর্বে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট অঞ্চলে নদী সংলগ্ন এলাকার মাটির ঘের দিয়ে বা পাড় বেঁধে তৈরি পুকুরে প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত খাদ্য থেকে চিংড়ি কয়েক মাসের মধ্যে বড় হলে তা সংগ্রহ করে বাজারজাত করা হতো। উপকূলীয় বাঁধ তৈরীর পরপরই দেশের সনাতন চিংড়ি চাষ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। সত্তর দশকের পর বিশ্ববাজারে চিংড়ির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাঁধের অভ্যন্তরে পুনরায় চিংড়ি চাষের সূচনা হয়। বস্ত্তত চিংড়ি চাষ এখনও বিজ্ঞানসম্মতভাবে চালু হয় নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক উৎস থেকে পোনা সংগ্রহ করে ঘেরে লালন-পালন করা হয়। খুলনা, বাগেরহাট, পাইকগাছা ও সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চল ছাড়াও বর্তমানে চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার, মহেষখালী, চকোরিয়া সুন্দরবন, কুতুবদিয়া ও টেকনাফে চিংড়ি চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে।
পানির লবণাক্ততার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের চিংড়ি চাষকে দুভাগে ভাগ করা হয়। যেমন অল্পলোনা পানির চিংড়ি চাষ ও স্বাদুপানির চিংড়ি চাষ।
অল্পলোনা পানির চিংড়ি চাষ বস্ত্তত বাংলাদেশের চিংড়ি চাষ বলতে অল্পলোনা পানির চিংড়ি চাষকেই বোঝায়। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা জেলায় এবং দক্ষিণ-পূর্ব এলাকায় চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলায় দেশের প্রায় সব চিংড়ি খামার অবস্থিত। এ দুটি অঞ্চলে বর্তমানে প্রায় ১,৪৫,০০০ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে।
উপকূলীয় এলাকায় চাষকৃত চিংড়ি প্রজাতির মধ্যে বাগদা চিংড়ি Penaeus monodon-এর গুরুত্ব বেশি। মোট উৎপাদনের শতকরা ৮০ ভাগই বাগদা চিংড়ি। এর পরে রয়েছে হরিণা চিংড়ি Metapenaeus monoceros। কতিপয় খামারে P. indicus ও M. brevicornis চাষ হয়ে থাকে। চিংড়ির সঙ্গে অন্য লোনাপানির মাছ যেমন বাটা, ভেটকি, টেংরা ইত্যাদিও জন্মে। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে ধান চাষের সঙ্গে খামারে অনেক সময় স্বাদুপানির গলদা চিংড়ি Macrobrachium rosenbergii ও অন্যান্য কয়েকটি মাছের পোনাও ছাড়া হয়। ধান কাটার পর চিংড়ি ও মাছ সম্পূর্ণভাবে আহরণ করা হয়।
বাংলাদেশে সাধারণত তিনভাবে চিংড়ি চাষ করা হয় ১. এককভাবে চিংড়ি চাষ; ২. পর্যায়ক্রমে চিংড়ি ও ধান চাষ; ৩. পর্যায়ক্রমে লবণ উৎপাদন ও চিংড়ি চাষ।
এককভাবে চিংড়ি চাষ একক চিংড়ি চাষ বলতে প্রধানত উপকূলীয় এলাকায় বাগদা চিংড়ির চাষকেই বোঝায়। যেখানে জোয়ারভাটার প্রভাব রয়েছে সে এলাকা একক চিংড়ি চাষের জন্য উপযোগী।
খুলনা জেলার চিংড়ি খামারগুলির অধিকাংশই উপকূলীয় বাঁধের ভেতরে অবস্থিত। এগুলি এককভাবে চিংড়ি চাষের জন্য ব্যবহূত হয়। একটি আদর্শ খামারে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য যেসব দিকে দৃষ্টি রাখা হয় তা হলো, খামারকে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে বেষ্টনী বাঁধের ব্যবস্থা রাখা। বেষ্টনী বাঁধ সাধারণত ২-৩ মিটার উঁচু হয়, যেন সর্বোচ্চ জোয়ারের সময়ও বাঁধের উপর দিয়ে পুকুরে পানি ঢুকতে না পারে। এ ছাড়া খামারে পানি ও চিংড়ির পোনা ঢুকানোর জন্য হেড ক্যানাল (head canal)-এর ব্যবস্থা থাকে। প্রকল্প থেকে প্রয়োজনে পানি নিষ্কাশনের জন্য ফিডার ক্যানাল (feeder canal) থাকে। অনেক সময় অভ্যন্তরীণ বাঁধ নির্মাণ করে খামারে পোনা প্রতিপালনের জন্য ছোট ছোট নার্সারি পুকুর (nursery pond) তৈরি করা হয়। খামারের প্রতিটি পুকুরে সঠিকমাত্রায় পানির গভীরতা বহাল রাখতে স্লুইস গেট (sluice gate)-এর ব্যবস্থা থাকে। স্লুইস গেট চিংড়ি খামারের অন্যতম প্রধান অবকাঠামো। বড় আকৃতির প্রধান স্লুইস গেট ফিডার ক্যানাল-এর মুখে বসাতে হয়। অল্প ব্যয় এবং রক্ষণাবেক্ষণের সুবিধার জন্য সাধারণত কাঠের তৈরি গেট ব্যবহার করা হয়।
বড় আকারের খামার ২০-২২ একর পর্যন্ত হয়। খামারের নার্সারি পুকুরের আয়তন সাধারণত পালন পুকুরের দশভাগের এক ভাগ হয়ে থাকে। পালন পুকুরের গভীরতা ১ থেকে ১.৫ মিটার পর্যন্ত এবং নার্সারি পুকুরের গভীরতা অনধিক ০.৭৫ মিটার। প্রতিবার চিংড়ি চাষ শুরু করার আগে পুকুর থেকে পানি সম্পূর্ণ বের করে নিতে হয়। পুকুরে খাদ্য ঘাটতি রোধের জন্য হেক্টর প্রতি ২৫০ কেজি জৈব সার এবং ৫০ কেজি অজৈব সার প্রয়োগ করতে হয়। সার প্রয়োগের পরে পানির গভীরতা ৪০-৫০ সেমি রেখে এক সপ্তাহ পর পোনা ছাড়তে হয়।
খামারে সাধারণত দুভাবে পোনা মজুত করা হয়। সারা বছরই উপকূলীয় নদী ও খালে চিংড়ির লার্ভা পাওয়া যায়। সাধারণত পানির উপর স্তরে লার্ভা বাস করে। সে কারণে পানি প্রবেশ পথের স্লুইস গেট এমনভাবে খুলে দেওয়া হয় যেন জোয়ারের সময় কেবল উপর স্তরের পানি ঘেরে প্রবেশ করে। এ পানির সঙ্গে চিংড়ির লার্ভা খামারে ঢোকে।
ইদানিং প্রাকৃতিক উৎস থেকেও লার্ভা সংগ্রহ করে প্রথমে নার্সারি পুকুরে ও পরে পালন পুকুরে মজুত করা হয়। নার্সারি পুকুরের জন্য একর প্রতি ২,৫০,০০০-৩,০০,০০০ পোনা এবং পালন পুকুরে একর প্রতি ১৫,০০০-৩০,০০০ পোনা ছাড়া হয়। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে সমুদ্র উপকূল থেকে প্রচুর পরিমাণ লার্ভা সংগ্রহ করে তা ব্যবহার করা হচ্ছে। হ্যাচারিতে উৎপাদিত লার্ভার পরিমাণ চাহিদার চেয়ে কম বলে অধিকাংশ খামার প্রাকৃতিক উৎসের ওপরই বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
বাগদা চিংড়ি সাধারণত ৪ মাসের মধ্যে গড়ে ৫০-৬০ গ্রাম ওজন হয় এবং তখন তা বাজারজাত করা যায়। উন্নততর পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনা করলে হেক্টর প্রতি ৫০০-৬০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদন করা সম্ভব।
পর্যায়ক্রমে চিংড়ি ও ধান চাষ এ পদ্ধতিতে ঘেরের ভেতরে পুকুরে পালাক্রমে চিংড়ি ও ধান চাষ করা হয়। শীতকালে ঘেরের ভিতর জোয়ারের পানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ এবং বর্ষার আগে চিংড়ি আহরণ করে একই ঘেরে ধান ও অন্য মাছ চাষ করা হয়। জোয়ারের পানির সঙ্গে চিংড়ির লার্ভা ও অন্যান্য লোনাপানির মাছের পোনা প্রবেশ করে। বর্ষার শুরুতে জুন-জুলাই মাসে চিংড়ি ধরে নেওয়া হয়।
পর্যায়ক্রমে লবণ উৎপাদন ও চিংড়ি চাষ চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও কক্সবাজারের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকায় পর্যায়ক্রমে একই জমিতে লবণ উৎপাদন ও চিংড়ি চাষের প্রথা চালু আছে। সেখানে নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত লবণ তৈরি করা হয়। মে মাস থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চিংড়ি চাষ করা হয়।
স্বাদুপানির চিংড়ি চাষ স্বাদুপানিতে এখনও ব্যাপকভাবে চিংড়ি চাষ শুরু হয় নি। দেশে স্বাদুপানিতে চাষ উপযোগী চিংড়ি হচ্ছে গলদা চিংড়ি। তবে M. malcolmsonii-ও চাষ করা সহজ। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের সর্বত্রই এ চিংড়ির বিচরণ। গলদা স্বাদুপানিতে বাস করলেও প্রজনন মৌসুমে ডিম ছাড়ার জন্য ঈষৎ লবণাক্ত পানিতে চলে আসে। তাই মোহনা ও খাড়ি অঞ্চলের নদীতে যেখানে জোয়ার-ভাটা হয় সেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশে এদের প্রচুর লার্ভা পাওয়া যায়। কৃত্রিম উপায়ে এখন কক্সবাজার, চট্টগ্রামের পটিয়া, নোয়াখালীর ব্যাকইয়ার্ড হ্যাচারি এবং আরও কয়েকটি হ্যাচারিতে গলদা চিংড়ির পোনা উৎপাদন করা হচ্ছে।
আলোবাতাস সমৃদ্ধ গাছপালা মুক্ত খোলা জায়গায় গলদা চাষের জন্য এক থেকে তিন বিঘা আয়তনের ৪-৫ ফুট গভীর আয়তাকার পুকুর সবচেয়ে ভাল। মাটি ও পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করে উপযুক্ত পুকুরে হেক্টর প্রতি ২০,০০০-৫০,০০০ পোনা মজুদ করতে হয়।
পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য, যেমন ভাসমান ছোট ছোট উদ্ভিদ ও জু-প্ল্যাঙ্কটন (zooplankton), কাঁকড়া, ঝিনুক, ও শামুকের বাচ্চা, ছোট মাছ, মাছের ডিম, মৃত জলজ প্রাণীর পচা অংশ ইত্যাদি গলদা চিংড়ির খাদ্য। দ্রুত ও সন্তোষজনক বৃদ্ধির জন্য সম্পূরক খাবার দিতে হয়। পুকুরে খাদ্য উৎপাদনের জন্য জৈব ও রাসায়নিক সার পরিমাণ মতো দু সপ্তাহ পর পর প্রয়োগ করলে চিংড়ি দ্রুত বড় হয়।
মৎস্য অধিদপ্তরের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় ২০০৪-০৫ অর্থবছরে মোট চিংড়ির উৎপাদন ছিল ১,৯৫,৬৯০ মে টন। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ জলাশয় থেকে সংগৃহীত হয়েছিল ১,৫১,৪২৯ মে টন এবং সমুদ্র থেকে ৪৪,২৬১ মে টন।
১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে চিংড়ি রপ্তানি করে বাংলাদেশ ১২২৩.৪ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। এ সময় জাতীয় রপ্তানি আয়ের মধ্যে চিংড়ির অবদান ছিল ৮.২%। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পাশাপাশি চিংড়ি চাষ অনেকের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর এক উল্লেখযোগ্য অংশ চিংড়ির পোনা সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত। মৎস্য অধিদপ্তরের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, সারা বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ মানুষ চিংড়ি চাষ, ব্যবসা, রপ্তানি ও চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। [এস.এম হুমায়ুন কবির]
পরিবেশগত ও আর্থ-সামাজিক প্রভাব সাম্প্রতিক বছরগুলিতে হিমায়িত চিংড়ি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। উপকূলীয় চিংড়ি চাষের খাত থেকেই এ পণ্যের সিংহভাগ আহরিত হয়। এতে চিংড়িচাষের পাশাপাশি মুক্ত জলাশয় থেকে চিংড়িপোনা ধরার কাজ এবং হিমায়িত চিংড়ি শিল্পগুলি হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশে চিংড়ি চাষের জন্য কোনো আচরণবিধি বা জাতীয় কর্মকৌশল না থাকায় উপকূল এলাকায় চিংড়ি চাষ অনিয়ন্ত্রিত, অসমন্বিত ও অপরিকল্পিতভাবে অতি দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে। নিকট অতীতে চিংড়ি চাষের বিস্তৃতি খুবই লক্ষণীয়: ১৯৮০ সালে যেখানে স্বল্পলোনা পানির পুকুরগুলির সর্বমোট আয়তন ছিল ২০,০০০ হেক্টরেরও কম সেখানে ১৯৮৫ সালে আয়তন বেড়েছে ৭০,০০০ হেক্টর, ১৯৮৯ সালে ১,১৫,০০০ হেক্টর আর বর্তমানে প্রায় ১,৪৫,০০০ হেক্টর। চিংড়ি খামার প্রধানত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত খুলনা (২৯%), সাতক্ষীরা (১৯%) ও বাগেরহাট (২৯%) জেলাগুলিতে এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে প্রধানত কক্সবাজার জেলায় এবং বাকিগুলি অন্যান্য সমুদ্রোপকূলীয় জেলাসমূহে।
ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ধ্বংস ও আনুষঙ্গিক প্রভাব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশের মতো বাংলাদেশেও উপকূলীয় চিংড়ি চাষ বাড়ানোর জন্য ম্যানগ্রোভ এলাকাগুলি দ্রুত ধ্বংস করা হয়েছে। এ দেশের উপকূলীয় দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় মূল্যবান ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংসের বিনিময়ে অধিকাংশ চিংড়ি খামার গড়ে উঠেছিল। এক সময় গোটা চকোরিয়া সুন্দরবন জুড়ে ছিল সুন্দরীজাতীয় গাছপালার গভীর বন এবং ১৮,২০০ হেক্টর আয়তনের এ বন সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে গণ্য হতো। চিংড়ি চাষের সূচনাকালে চিংড়ি-পুকুর কাটার জন্য অধিকাংশ ম্যানগ্রোভ বন (৫০ শতাংশের বেশি) দ্রুত কেটে উজাড় করা হয়। ইজারাদাররা নির্মমভাবে ইজারাপ্রাপ্ত জমির বন উজাড় করে ফেলে। জীবনধারণের নানা কর্মকান্ড এবং অবকাঠামোগত বিকাশের প্রয়োজনে ইজারা বহিস্থ অঞ্চলও উত্তরোত্তর গ্রাস হতে থাকে।
ম্যানগ্রোভ বনের ওপর চিংড়ি চাষের প্রভাব যেভাবে আবাসস্থলের রূপান্তর ঘটিয়েছে তা আশঙ্কাজনক। বাংলাদেশে ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংসের ফলে মাছ ও চিংড়ির কত প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে বা বিপন্ন হয়ে পড়েছে অথবা অন্যত্র চলে গেছে তার সঠিক তথ্য নেই। বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পাখনাবিশিষ্ট মাছ, কাঁকড়া ও শামুক জাতীয় প্রাণীর সূতিকাগার বা স্বাভাবিক আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র হিসেবে এবং উপকূলীয় উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য জৈব পদার্থের উৎস ও পুষ্টিচক্রের আবর্তক হিসেবে ম্যানগ্রোভ বনগুলি আবশ্যকীয় কার্যকর ভুমিকা পালন করে। ম্যানগ্রোভ এলাকা নানা ধরনের মাছ, শামুক, কাঁকড়া ও কাঁকড়াজাতীয় প্রাণীর চাষের সহায়ক, তাই এগুলির অবনতি ঘটলে এসব সুযোগ চিরতরে নষ্ট হয়ে যাবে।
ম্যানগ্রোভ বন উচ্ছেদের ফলে উপকূলের ভূমিক্ষয় ঘটছে, পলির স্তরায়ণ ও উপকূল ভাগের ভূপ্রকৃতির পরিবর্তন ঘটছে বলেও জানা গেছে। বাস্ত্তসংস্থানিক গুরুত্ব ছাড়াও চকোরিয়া সুন্দরবনের আশেপাশের জনসাধারণ বন এলাকা থেকে জ্বালানি কাঠ, খড়জাতীয় সামগ্রী, ঘরবাড়ি নির্মাণের কাঠ, বিভিন্ন ধরনের খাদ্য, যেমন মধু, মাছ ইত্যাদি সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করত। ম্যানগ্রোভ বন উচ্ছেদের ফলে এ এলাকার জনসাধারণ এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
মানুষের বসতির ওপর প্রভাব এ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে একই জমিতে গ্রীষ্মকালে (মার্চ-জুন) ও বর্ষাকালে (জুলাই-নভেম্বর) যথাক্রমে মাছচাষ ও ধানচাষ চলে আসছে। প্রভাবশালী ও বিত্তশালীরা দ্রুত চিংড়ি চাষ বাড়ালে স্থানীয় বাসিন্দা, চাষি, তৃণমূল নেতৃবৃন্দ, এতদঞ্চলে কর্মরত এনজিও ও স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা চিংড়ি চাষের মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে আপত্তি উত্থাপন করেন।
চিংড়ি খামারের উদ্যোক্তা ও বড় চিংড়ি-ঘেরের জমির মালিকেরা ঘেরগুলি নিয়ন্ত্রণ করে, ছোট জমির দরিদ্র মালিকেরা উদ্যোক্তাদের জমি ইজারা দেওয়ার বিনিময়ে অতি সামান্য অর্থ (হারি বলা হয়) লাভ করে। উদ্যোক্তারা একতরফা ইজারার মূল্য স্থির করে যা সনাতনী পন্থায় এ জমিতে ধানচাষের মাধ্যমে অর্জিত আয়ের এক ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। সেখানে জমির অনেক অনুপস্থিত মালিক ‘হারি’র তোয়াক্কা করে না, ফলে ঘেরের মালিকরা এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্থানীয় চাষিদের হারি দেওয়া বন্ধ রাখে। সরকারি জমির (খাস জমি) ইজারাদান পদ্ধতিও খুব স্বচ্ছ নয় এবং কেবল বিত্তবান, ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই এ ধরনের জমির ইজারা পাওয়ার সামর্থ্য রাখে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বড় বড় ঘের তৈরির জন্য ছোট জমির মালিকদের সমবায়ে যোগদানের আহবান জানায়, কিন্তু এ ব্যাপারে স্থায়ী অভিযোগ রয়েছে যে ছোট জমির মালিকরা লাভের ন্যায্য হিস্যা বা ঘের-ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণের সুযোগ কোনোটাই পায় না।
কখনও একটি এলাকা চিংড়ি চাষের আওতায় এসে গেলে ঘেরের মালিকেরা ছোট ছোট ধানক্ষেতের লাগোয়া বিশাল এলাকা লোনাপানিতে ডুবিয়ে দেয়, তাতে (ঘেরের বাইরের ও ভিতরের) গোটা এলাকায় জমির উৎপাদন ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। পরিণামে এসব জমির মালিকেরা নিজের জমিকে চিংড়ির ঘেরে পরিণত করে বা বড় ঘেরের মালিকদের কাছে জমি ইজারা দিতে বাধ্য হয়। এভাবে বিশাল এলাকায় চিংড়ি চাষ ক্রমে ক্রমে ধান চাষের জায়গা দখল করে নেয়। স্থানীয়ভাবে চাষের উপযোগী বেশ কয়টি ঐতিহ্যবাহী ধানের জাত (গাঁশি, কালশি ইত্যাদি) তথা মূল্যবান জার্ম প্লাজম ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময় সাতক্ষীরা জেলা ছিল চালের উদ্বৃত্ত এলাকা, কিন্তু বর্তমানে সেখানে বাইরে থেকে চাল আসে।
চিংড়ি চাষের দরুন বহুমুখী শস্যচাষ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এসব এলাকায় ধান ছাড়া অন্য শস্য, গবাদি পশুর খাদ্য, শাকসবজি ইত্যাদি বর্তমানে আর জন্মানো যাচ্ছে না। কাজেই চিংড়ি চাষের এলাকায় এসব ফসলের দারুণ অভাব দেখা দিয়েছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এসবের দাম যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।
মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে ফলের গাছসহ সব ধরনের গাছের সংখ্যা ১০% থেকে ৩০% কমে গেছে। পরিণামে চিংড়ি চাষ বহু প্রান্তিক চাষীকে বসতবাড়ি ও ছোট জমি খন্ড পরিত্যাগ করে নিকটবর্তী শহর বা নগরের বস্তিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। [নূরউদ্দিন মাহমুদ]
আরও দেখুন কাঁকড়া; |ক্রাস্টেসিয়ান; টলবস্টার।