চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ

চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ  সরকারি আইন বা বিধি-বিধান ও আদেশ-নির্দেশ, যার দ্বারা চলচ্চিত্রকে সর্বসাধারণ্যে প্রদর্শনের অনুমোদন বা অননুমোদন করা হয়। দ্য বাংলাদেশ সেন্সরশিপ অব ফিল্ম রুলস-১৯৭৭ এর আলোকে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র অনুমোদন প্রাপ্ত হয়। এ বিধির ভিত্তি ব্রিটিশ ভারতে প্রবর্তিত দ্য সিনেমাটোগ্রাফ অ্যাক্ট-১৯১৮, যা ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তান রাষ্ট্রে এবং বিভিন্ন সময়ে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে আরও সংশোধিত ও সংযোজিত হয়। ১৯১৮ সালে সিনেমাটোগ্রাফ আইনের লক্ষ্য ছিল প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের নিরাপত্তা বিধানকল্পে যথাযথ কর্তৃপক্ষ দ্বারা চলচ্চিত্র প্রদর্শনের আয়োজন এবং সেন্সর কর্তৃপক্ষ দ্বারা চলচ্চিত্রের ছাড়পত্র প্রদান। এ আইনের ক্ষমতাবলে ১৯২০ সালে কলকাতা, মুম্বাই ও মাদ্রাজে চলচ্চিত্র সেন্সরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। সেন্সরসভা ব্রিটিশ ভারতে নির্মিত এবং বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ছবি সেন্সর করে মুক্তির ছাড়পত্র প্রদান করতো। ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান সরকার সংশোধিত আইন অনুসারে লাহোর, করাচি ও ঢাকায় সেন্সরসভা প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৬৩ সালে সরকার সেন্সরশিপ ও ফিল্ম অ্যাক্ট এবং সেন্সরশিপ অব ফিল্মস রুলস প্রবর্তন করে। এ বিধি অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ফিল্ম সেন্সর বোর্ড ও দুই প্রদেশে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানে প্রাদেশিক ফিল্ম সেন্সর বোর্ড স্থাপিত হয়। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ফিল্ম সেন্সর অ্যাক্ট-১৯৬৩ কে রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ৪১/১৯৭২ সংশোধন করে চলচ্চিত্র সেন্সর বিধি চালু করা হয়। ১৯৮২ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী এ বিধি সংশোধন করা হয়। ১৯৭২-এর চলচ্চিত্র বিধি বাতিল করে ১৯৭৭-এ প্রণীত হয় ‘দ্য বাংলাদেশ সেন্সরশিপ অব ফিল্মস রুলস’। রাজধানী ঢাকায় একটি চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়।

সেন্সরশিপ অব ফিল্মস রুলস-এ রয়েছে এর শিরোনাম, সংজ্ঞা, সেন্সর বোর্ডের গঠন, মেয়াদ, দায়িত্ব, আপিল কমিটি গঠন, ছবি পরীক্ষণের নীতিমালা, ৩৫ মিলিমিটার ও ১৬ মিলিমিটার ছবির ফি, ট্রেলার পরীক্ষণ, বিদেশি মিশনসমূহের ছবি পরীক্ষণ, কর্তিত বা বর্জিত দৃশ্য ও ছবির বিবরণ, বিভিন্ন ফরম, শিক্ষামূলক চলচ্চিত্রের ফি মওকুফ ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ। সেন্সর নীতিমালার ১৩ নং ধারার আলোকে ১৯৮৫-এর ১৬ নভেম্বর তথ্য মন্ত্রণালয় চলচ্চিত্র পরীক্ষণের ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে ৮ দফা নির্দেশ জারি করে। এ ৮ দফার প্রথম ৬টি দফায় কোনো জাতীয় ছবিকে প্রদর্শনের অযোগ্য বলে বিবেচনা করা হবে এবং ছাড়পত্র দেওয়া হবে না সে সম্পর্কে বলা হয়েছে। এ সকল ছবির আওতায় পড়ে, ১. বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সংহতি, সার্বভৌমত্ব, আইন-শৃঙ্খলা, মূল্যবোধ, সামাজিক রীতি-নীতি, ঐতিহ্য, দেশরক্ষা বাহিনী, নিরাপত্তা বাহিনী বিরোধী সকল চলচ্চিত্র; ২. বাংলাদেশ এবং বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্রের মধ্যে বৈরিতা উসকে দিতে পারে বা জাতিসমূহের বা রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণার উদ্রেক করবে এমন সকল চলচ্চিত্র; ৩. জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতিতে আঘাত করবে বা ধর্মীয় গোত্রের মধ্যে বিভেদ ছড়াবে বা সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াবে এমন চলচ্চিত্র; ৪. সেইসব চলচ্চিত্র যেগুলির বিষয়বস্ত্ত অনৈতিক এবং কুকর্মকে উস্কে দেবে বা প্রতিষ্ঠিত নীতিবোধ ও পবিত্রতাকে কলুষিত করবে বা প্রকাশ্য নগ্নতা, ধর্ষণ, যৌনকর্ম, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি ও পোশাক-পরিচ্ছদ, চুম্বন, আলিঙ্গন ইত্যাদিতে ভরপুর থাকবে; ৫. নিষ্ঠুরতা, মারাত্মক নির্যাতন, বীভৎসতা, পাশবিকতা থাকবে এমন সব চলচ্চিত্র; এবং ৬. এমন সব চলচ্চিত্র যেগুলির মারাত্মক অপরাধমূলক কার্যকলাপের দৃশ্য জনমনে উৎসাহ জোগাবে বা অপরাধীদের সম্পর্কে সহানুভূতি জাগাবে, সমাজে স্বীকৃত কাজ বলে ধারণা ও প্ররোচনা দেবে। সপ্তম দফায় বলা হয়েছে যে দেশি বা বিদেশি ছবির নকল ছবিকে ছাড়পত্র দেওয়া হবে না। পরিশেষে, অষ্টম দফায় যৌতুক দেওয়া-নেওয়াকে নিন্দা না করে বরং উৎসাহ প্রকাশকারী বিষয়বস্ত্ত-নির্ভর ছবিকেও ছাড়পত্র দেওয়া হবে না বলে ব্যক্ত করা হয়েছে।

১৯৭২ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত সেন্সর বিধির আওতায় বিভিন্ন অভিযোগে বাংলাদেশে প্রায় দ’ুশো দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে বিদেশি ছবি ছাড়া সব দেশি ছবিই শেষপর্যন্ত ছাড়পত্র পেয়েছে। অন্যদিকে অশ্লীল কাটপিস বা কর্তিত দৃশ্য সংযোজন করা কিছু ছবি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের সময় আটক করা হলেও পরে বিশেষ ক্ষমার আওতায় সেসব ছবি আবার প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বিদেশি যেসব চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেসবের শতকরা প্রায় একশোটিই নিম্নমানের ও কুরুচিপূর্ণ।  [অনুপম হায়াৎ]