চর

চর  সাগর, মহাসাগর, হ্রদ অথবা নদী দ্বারা বেষ্টিত ভূখন্ড। সাধারণত নদীর গতিপ্রবাহে অথবা মোহনায় পলি সঞ্চয়নের ফলে গড়ে ওঠা ভূভাগকে চর বলে আখ্যায়িত করা হয়। বাঁকের চর (point-bars) বা পার্শ্বীয় চর এবং মধ্য চরা (medial or braid bars) সহ সকল ধরনের চর সাধারণভাবে চর নামেই অভিহিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের নদনদীর ভাঙাগড়ার প্রক্রিয়ায় নদীর প্রবাহখাতে দ্বীপচর হিসেবে অথবা নদীতীরে সংযুক্ত ভূভাগ হিসেবে বালুচর গড়ে ওঠে। সীমিত ভূভাগের এ দেশে গড়ে ওঠা চরগুলি প্রায়ই নতুন বসতি স্থাপনের এবং নতুন কৃষিজমি তৈরির সুযোগে করে দেয়। দ্বীপচর এবং প্রধান ভূভাগের সঙ্গে সংযুক্ত চরের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। দ্বীপচরগুলি বছরের সব সময়ই পানিবেষ্টিত থাকে, আর সংযুক্ত চরগুলি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকালীন সময়ে মূল ভূভাগের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। তবে উদ্ভিদ দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে পড়লে উভয় চরকেই সাধারণভাবে চর বলে আখ্যায়িত করা হয়।

বাংলাদেশে চরগুলিকে নদনদীর জল-অঙ্গসংস্থানিক (hydro-morphological) গতিশীলতার ফলে সৃষ্ট উপজাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এশিয়া ও নিকট প্রাচ্য অঞ্চলের জন্য সেচ সহায়তা প্রকল্প (The Irrigation Support Project for Asia and the Near East-ISPAN)- ইসপান নামক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে,  যে সকল চর তাদের উৎপত্তির প্রথম চার বছরে ক্ষয়প্রাপ্ত বা ভাঙনের শিকার হয় না, সে সকল চরে এ চার বছরের শেষদিকে কৃষিকাজ কিংবা বসতি স্থাপন শুরু করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বি.বি.এস) এর ১৯৯৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, তুলনামূলকভাবে নদীর ভাটি অঞ্চলে সৃষ্ট চরগুলির মাটি অধিকতর উর্বর এবং এ সকল চরে শস্য নিবিড়তা ১৫০ থেকে ১৮৫-এর মধ্যে যা দেশের গড় শস্য নিবিড়তা ১৬৫-এর প্রায় কাছাকাছি। তা সত্ত্বেও দ্বীপচর এবং সংযুক্ত চরগুলি সংলগ্ন মূল ভূভাগ এলাকার তুলনায় কম উৎপাদনক্ষম। এর প্রধান কারণগুলি হচ্ছে চরভূমির মৃত্তিকা গুণাবলী শস্য উৎপাদনের জন্য তুলনামূলকভাবে কম অনুকূল হওয়া, ক্ষয়ীভবন এবং ঘন ঘন বন্যার ফলে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা প্রভৃতি।

যদিও চরে নদীর পানি এবং ভূগর্ভস্থ পানি দুইই সহজলভ্য, তবুও আপার মেঘনা নদীগঠিত চরগুলি ব্যতীত অন্যত্র চরগুলিতে সেচযোগ্য ফসল খুব কমই ফলানো হয়ে থাকে। কিছু কিছু চরে সফলভাবে বনায়ন সাধিত হয়েছে। চর সংলগ্ন নদীতে সারাবছর পানি থাকে বলে চরে বসবাসকারী অনেক সম্প্রদায়ই বছরের বেশিরভাগ সময় মৎস্য আহরণে নিয়োজিত থাকে।

বহু চরে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ঘাস জন্মায়। এ সকল তৃণভূমি গবাদিপশুর জন্য উত্তম চারণভূমি হিসেবে ব্যবহূত হয়ে থাকে। চরাঞ্চলে উদ্ভিজ্জ আবরণ গড়ে ওঠার প্রাথমিক পর্যায়ে প্রচুর পরিমাণে ক্যাটকিন জাতীয় ঘাস জন্মে থাকে যা গ্রামাঞ্চলে কুঁড়েঘরের চাল ছাওয়ার উপাদান হিসেবে ব্যবহূত হয়ে থাকে। কিছু কিছু চরে বালু আহরণের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে যা নির্মাণ উপকরণ হিসেবে বালুর চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

বাংলাদেশের চরগুলি অত্যধিক ক্ষয়কার্য এবং বন্যাপ্রবণ। ধারাবাহিক উপগ্রহ চিত্রের একটি সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, যমুনা নদীর তীরবর্তী এলাকার ৯৯ শতাংশেরও বেশি ভূমি ছিল চর। গত ২৭ বছরে অর্থাৎ ১৯৭৩ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে একই বিশ্লেষণে আরও দেখা গিয়েছে যে, এ সকল চরের প্রায় ৭৫ ভাগই এক থেকে নয় বছরের মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়েছে এবং প্রায় ১০ ভাগ চর ১৮ বছর কিংবা তার অধিক সময়কাল পর্যন্ত টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছে। তবে কয়েকটি বিশেষ এলাকায় যেমন আপার মেঘনা এলাকায় গঠিত চরগুলি স্থিতিশীল হয়ে টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছে।

১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সময়কালে আপার মেঘনা ব্যতীত অন্যান্য সকল নদীতে চর এলাকার বিস্তৃতি ঘটেছে। উল্লিখিত সময়কালে চর এলাকার মোট প্রবর্ধনের পরিমাণ ছিল ৩৬,০০০ হেক্টর। নদীভাঙন এবং নদীখাতের বিস্তৃতির ফলে চর এলাকায় বসবাসকারী জনগণ অবর্ণনীয় ক্ষতির শিকার হয়। ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭,২৯,০০০ মানুষ নদীভাঙনের শিকার হয়ে বাস্ত্তভিটা চ্যুত হয়ে পড়েছে। এদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকেরও বেশি মানুষ যমুনার ভাঙন কবলিত হয়ে গৃহহীন হয়েছে।

প্রতি বছর চরগুলির একটি বিরাট অংশ বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। আগাম বন্যা সংঘটিত হলে চরের জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চরের অধিবাসীরা সাধারণত সহজলভ্য উঁচু জমিতে তাদের বসত গড়ে তোলে এবং স্থায়ী বসত গড়ে তোলার বেলায় বার্ষিক প্লাবন থেকে ভিটিকে মুক্ত রাখার জন্য মাটি ভরাট করে ভিটিকে প্লাবনসীমার আওতামুক্ত করে নেয়। মূল ভূমির সঙ্গে সংযুক্ত চরের তুলনায় দ্বীপ চরগুলি অধিকতর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। আবার বিভিন্ন নদীখাতে গড়ে ওঠা চরগুলির মধ্যে গঙ্গা নদীখাতের বিভিন্ন অংশে গড়ে ওঠা চরগুলি সর্বাধিক বন্যা কবলিত হয়ে থাকে।

বাংলাদেশের চরগুলিকে পাঁচটি উপ-এলাকায় ভাগ করা হয়েছে, যথা: যমুনা নদী, গঙ্গা নদী, পদ্মা নদী, আপার মেঘনা এবং লোয়ার মেঘনা নদীর চরসমূহ। এ সকল চর ছাড়াও অন্যান্য চর রয়েছে যেমন, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী এবং তিস্তা নদীর চরসমূহ। তবে প্রধান প্রধান নদীর চরগুলির তুলনায় এ সকল চর খুবই সামান্য ভূমি নিয়ে গঠিত। ১৯৯৩ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে চরভূমির মোট পরিমাণ ছিল প্রায় ১,৭২২ বর্গ কিমি।

যমুনা নদী  চরোৎপাদী যমুনা নদী প্রবাহে বিভিন্ন আয়তনের চর গড়ে উঠেছে। ১৯৯২ সালে শুষ্ক মৌসুমে তোলা ল্যান্ডস্যাটের প্রতিচ্ছবি (Landsat image) থেকে দেখা যায়, যমুনা নদীতে ৫৬টি বৃহৎ চর ছিল যাদের প্রতিটির দৈর্ঘ্য ছিল ৩.৫ কিমি-এরও বেশি। এগুলি ছাড়াও আরও ২২৬টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চর গড়ে উঠেছিলো যাদের দৈর্ঘ্য ছিল ০.৩৫ এবং ৩.৫ কিলোমিটারের মধ্যে। এ সকল চরের বেশিরভাগই ছিল বালুসমৃদ্ধ এবং উদ্ভিদ আচ্ছাদিত।

দ্বীপ চর [ছবি: আমানুল হক]

১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে যমুনা নদীর দুই তীরের আওতাভুক্ত এলাকা ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায় যার মধ্যে বালুপূর্ণ এলাকার পরিমাণ ছিল উল্লিখিত পরিমাণের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি। মোট বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এলাকার মধ্যে প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ ছিল জলাধার এবং এক-তৃতীয়াংশ ছিল গাছপালা তথা উদ্ভিদ আচ্ছাদিত ভূভাগ। এ পরিসংখ্যান থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, উল্লিখিত সময়কালে যমুনার বিনুনি অংশের প্রশস্তায়ন এবং সংশ্লিষ্ট প্লাবনভূমির ভাঙনসৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বালুচরা এবং গাছপালা আচ্ছাদিত এলাকার প্রবর্ধন দ্বারা ক্ষতিপূরণ হয়েছে। ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যে যমুনার যে অংশ থেকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী শাখায়িত হয়েছে সে অংশে, সিরাজগঞ্জের উত্তর ও পূর্বে এবং গঙ্গার সঙ্গে সঙ্গমের উজানে সর্বদক্ষিণ প্রবাহে ধারাবাহিকভাবে চর গঠিত হয়েছে।

গঙ্গা নদী  গঙ্গা নদীর চরগঠন প্রক্রিয়া যমুনা নদীর চরগঠন প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এ দুটি নদীরই জল-অঙ্গসংস্থানিক (hydro-morphological) এবং প্লানফর্ম বৈশিষ্ট্য আলাদা ধরনের হওয়ায় এদের চর গঠন প্রক্রিয়াও আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। যমুনা নদীর মতো বিনুনি আকৃতির নদীর চর গঠন প্রক্রিয়া গঙ্গা নদীর মতো সর্পিলাকার নদীর তুলনায় অধিকতর জটিল।

১৯৯৩ সালে গঙ্গা নদীর তীরবর্তী উদ্ভিজ্জ আচ্ছাদিত মোট চর ছিল ৩৫% এবং যমুনা নদীর তীরবর্তী উদ্ভিজ্জ আচ্ছাদিত মোট চর ছিল ৪৩%। বিনুনি এবং সর্পিলাকৃতি নদীর দুই ধরনের (সংযুক্ত এবং দ্বীপ চর) চরেরই রয়েছে পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট্য। উল্লিখিত সময়ে সংযুক্ত চর এলাকা থেকে দ্বীপ চর এলাকার অনুপাত গঙ্গা নদীতে ছিল ১.৬ এবং যমুনা নদীতে এ অনুপাত ছিল প্রায় ১.০।

সর্পিল বাঁকসমূহের স্থানান্তরের দ্বারা গঙ্গার প্রবাহখাতের সম্প্রসারণ সংঘটিত হয়েছে। যেহেতু সর্পিল বাঁকসমূহ গঙ্গা নদীর সক্রিয় খাতের মধ্যেই স্থানান্তরিত হয়েছে, সেহেতু চরসমূহ স্থানান্তরের দিক অনুযায়ীই গঠিত হয়েছে। সচরাচর সংকীর্ণ নদীখাতসমূহ, যমুনা নদীর বিনুনি প্রবাহসমূহ অথবা গঙ্গার মূল প্রবাহখাতের মতো সক্রিয় হয় না। এ কারণে গঙ্গা নদীখাতে গড়ে ওঠা চরসমূহ যমুনা নদীর চরের তুলনায় অধিকতর স্থিতিশীল হয়ে থাকে। তবে যেখানে নদীর প্লানফর্ম বিনুনি বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে সেখানে চরসমূহ কম স্থিতিশীল হয়।

পদ্মা নদী  ১৯৯৩ সালের শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা নদীতে মোট ১৩টি দ্বীপচর বিদ্যমান ছিল। প্রতিটি চরের দৈর্ঘ্য ছিল ৩.৫ কিলোমিটারেরও বেশি এবং অতিরিক্ত ১৮টি দ্বীপচরের প্রতিটির দৈর্ঘ্য ছিল ০.৩৫ এবং ৩.৫ কিলোমিটারের মধ্যে। এ সকল চরের মধ্যে উদ্ভিদ আচ্ছাদিত এবং উন্মুক্ত বালুচরও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

চরের গঠন নদীর প্রশস্ততার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মাওয়াতে পদ্মা নদী একক প্রবাহখাত বিশিষ্ট এবং সেখানে কোনো চর গড়ে ওঠে নি। তবে প্রবাহখাতের যেখানে নদীর প্রশস্ততা ১২ থেকে ১৫ কিমি, সেখানে প্রশস্ত এবং দীর্ঘ দ্বীপচর দৃশ্যমান হয়। চরের ভাঙন এবং প্রবর্দ্ধন নদীর সর্পিল বাঁকের স্থানান্তর দ্বারা নির্ণীত হয়ে থাকে। পদ্মার সংযুক্ত চরসমূহের আয়তন দ্বীপ চরসমূহের তুলনায় বেশি। যমুনা অথবা গঙ্গা নদীর তুলনায় পদ্মা নদীতে উদ্ভিদ আচ্ছাদিত চরের আয়তন অনেকাংশে কম। ১৯৮৪ সালে পদ্মা নদীর তীরবর্তী চরসমূহের মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ ছিল উদ্ভিজ্জ আচ্ছাদিত। ১৯৯৩ সালে এ পরিমাণ ২০ শতাংশে বৃদ্ধি পায়।

সংযুক্ত চর [ছবি: আমানুল হক]

আপার মেঘনা নদী  আপার মেঘনা নদীতে গড়ে ওঠা চরগুলি সম্পূর্ণরূপে স্থিতিশীল। নদীর প্রবাহখাত সমান্তরালে অবস্থিত অনেকগুলি খাতে বিভক্ত। এ খাতগুলি প্রত্যেকে এক একটি পৃথক সর্পিলাকৃতি নদীর ন্যায় আচরণ করে, তবে এরা বিনুনি গঠন করে না। এর ফলে এ ধরনের নদীখাতে গড়ে ওঠা চরগুলি বিনুনি নদীতে গড়ে ওঠা চরের মতো ভাঙাগড়ার পরিস্থিতির শিকার না হয়ে অধিক স্থিতিশীল হয়। আপার মেঘনা নদীর চরগুলি পুরোপুরিই দ্বীপ চর। এগুলির বেশিরভাগই ৭০ বছরেরও অধিককালের পুরানো। আপার মেঘনা নদীর তীরবর্তী মোট এলাকার ৩৮ ভাগই চর নিয়ে গঠিত।

লোয়ার মেঘনা  মেঘনা নদীর নিম্নতর অংশ তথা নদীর ভাটিতে গড়ে ওঠা চরগুলির বৈশিষ্ট্য পদ্মা ও আপার মেঘনা নদীর সঙ্গমস্থলে গড়ে ওঠা চরগুলির বৈশিষ্ট্য থেকে আলাদা। সঙ্গমস্থলে নদী খুবই প্রশস্ততা লাভ করায় চর গঠনের এলাকার পরিমাণও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে। ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সময়কালে মেঘনার প্রশস্তায়নের ফলে প্রায় ৪,৫০০ হেক্টর ভূমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। একই সময়কালে উদ্ভিদ আচ্ছাদিত চরের বৃদ্ধিও সাধিত হয়েছে যার পরিমাণ ছিল প্রায় ৩,০০০ হেক্টর। অন্যদিকে চাঁদপুরের নিম্নাংশে লোয়ার মেঘনা নদীপ্রবাহে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। ১৯৮৪ সালে নদীতীরে উদ্ভিদ আচ্ছাদিত চরের পরিমাণ ছিল মোট তীরভূমির মাত্র ২.৫ শতাংশ।

১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯৩ সালের মধ্যে প্রায় ১৪,৫০০ হেক্টর এলাকা ভাঙনের মাধ্যমে নদী ব্যাপক প্রশস্ততা লাভ করেছে। নদীর তীর ভাঙনের পাশাপাশি নতুন নতুন চর গঠন প্রক্রিয়াও ছিল সক্রিয়। এরূপে উদ্ভিদ আচ্ছাদিত চরের পরিমাণ ১৯৮৪ সালের ৯০০ হেক্টর থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৯৩ সালে ৪,৬০০ হেক্টরে দাঁড়ায়।

চাষাবাদ ও বসতি  অন্যান্য সকল নদীর তুলনায় যমুনা নদীতে চরের সংখ্যা সর্বাধিক। ১৯৯২ সালের হিসাব অনুযায়ী, যমুনা নদীর চর এলাকার মোট আয়তন ছিল প্রায় ১ লক্ষ হেক্টর যেখানে অন্যান্য সকল নদীর চর এলাকার মিলিত আয়তন ছিল ৭৫ হাজার হেক্টর। আবার শতকরা হিসাবে নদীর মোট তীর এলাকায় চরগঠিত ভূমির পরিমাণেও যমুনা নদীর স্থান অন্যান্য নদীর তুলনায় সর্বোচ্চ। যমুনা নদীতে যেখানে মোট তীরভূমির ৪৫ শতাংশ চরগঠিত ভূমি, সেখানে গঙ্গা ও পদ্মা নদীতে এ হার যথাক্রমে ৩০ শতাংশ এবং ২০ শতাংশ। লোয়ার মেঘনা নদীতে মোট তীরভূমির ২০ শতাংশ চরভূমি এবং আপার মেঘনা নদীতে এ পরিমাণ ৪০ শতাংশ। যমুনা নদীর উত্তরাংশ ব্যতীত অন্যান্য সকল নদীর চরাঞ্চলের মৃত্তিকা ও পানি বসতি স্থাপন এবং কৃষিকাজের জন্য অনুকূল বলে বিবেচিত।

বসতি চর

যমুনার উজান প্রবাহে গঠিত চরের মৃত্তিকা প্রধানত মোটা বালি দ্বারা গঠিত এবং কৃষিকার্যের জন্য খুব একটা উপযোগী নয়। লোয়ার মেঘনা নদীতে শুধুমাত্র শুকনা মৌসুমে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায় এবং চরাঞ্চলের পরিবেশের ওপর এর প্রভাব সীমিত। তবে বন্যা এবং চরের ভাঙন অধিক ক্ষেত্রে চাষাবাদ ও বসতি স্থাপনকে বাধাগ্রস্ত করে তোলে। যমুনা, গঙ্গা ও পদ্মা নদীতে স্থিতিশীল চরের সংখ্যা খুবই কম যেখানে আপার মেঘনা নদীর সকল চর খুবই স্থিতিশীল। লোয়ার মেঘনা নদীর বন্যাপ্রবণ অংশের চরগুলি অপেক্ষাকৃত নবীন এবং এদের মধ্যে অল্পসংখ্যক চরই স্থিতিশীলতা লাভ করেছে।

অত্যধিক গতিশীল বিনুনি বৈশিষ্ট্যের পরিণতিতে যমুনা নদীতে গড়ে ওঠা চরগুলি স্থিতিশীলতা লাভ করতে ব্যর্থ হয়। ভারতের আসাম ও তৎসংলগ্ন এলাকায় ১৯৫০ সালে সংঘটিত ভূমিকম্পের প্রতিক্রিয়ার ফলেও যমুনার চরগুলি স্থিতিশীল হতে পারে নি। এ ভূমিকম্পের ফলে প্রচুর পরিমাণে পলি যমুনা গর্ভে এসে জমা হয় যা পরবর্তী কয়েক দশক ধরে নিম্ন প্রবাহে পরিবাহিত হতে থাকে। নদীর পরিবহন ক্ষমতার তুলনায় বাহিত পলির পরিমাণ অত্যধিক হওয়ায় পলিরাশি ধীরে ধীরে নদীগর্ভের বিভিন্ন স্থানে সঞ্চিত হয়। বিপুল পরিমাণ পলি সঞ্চয়নের ফলে নদীর হ্রাসকৃত প্রবাহপথের প্রস্থচ্ছেদ বজায় রাখতে গিয়ে যমুনা নদী তার দুই তীরের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভূমিতে ভাঙন সংঘটিত করেছে। এ প্রক্রিয়ার ফলে বিগত ২৭ বছরে যমুনা নদীতে অব্যহতভাবে চর গঠিত হয়েছে এবং নদীর প্রশস্তায়নও সাধিত হয়েছে। যমুনা নদী প্রতি বছর গড়ে ১২৫ মিটার হারে প্রশস্ততা লাভ করেছে। এর ফলশ্রুতিতে বিগত ২৭ বছরে যমুনা নদীতে অব্যহতভাবে একই সাথে চর গঠন প্রক্রিয়া এবং নদীর প্রশস্তায়ন প্রক্রিয়া সক্রিয় ছিল। এক্ষেত্রে নদীতীরের অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্ম পললসমূহ ভাঙনের শিকার হয় এবং মোটা পলিসমূহ সঞ্চিত হয়ে পরিবৃদ্ধি লাভ করে।

সাম্প্রতিককালের উপগ্রহ চিত্রের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, নববই দশক থেকে যমুনার তীরভাঙনের মাধ্যমে নদীখাত প্রশস্তায়ন প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। পক্ষান্তরে বিগত বছরগুলিতে পদ্মা নদীর নদীখাত প্রশস্তায়ন প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পদ্মায় অধিকহারে চর জেগে ওঠার ফলে এরূপ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উজান অঞ্চলে চাষাবাদের জন্য অব্যহতভাবে বনাঞ্চল ধ্বংসকে গঙ্গা নদীতে পলি সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য দায়ী করা হয়ে থাকে।

জনসংখ্যা  ১৯৯৩ সালের এক হিসাব অনুযায়ী চরসমূহের মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৬,৩১,০০০। এর বেশিরভাগই (প্রায় ৬৫ শতাংশ) যমুনা নদীর বিভিন্ন চরের অধিবাসী। ১৯৮৪ সালের হিসাবের তুলনায় ১৯৯৩ সালে চরের জনসংখ্যা ৪৭ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়কালে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ছিল প্রায় ২৬ শতাংশ। এসকল হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে যে, মানব বসতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চরসমূহের গুরুত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

চরের অধিবাসীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা নদীভেদে এবং কখনও কখনও একই নদীর উজান, মধ্যগতি এবং ভাটি অঞ্চলের চরভেদে বিভিন্ন হয়। নদীর ভাঙাগড়া আর প্লাবনের সাথে চরের অধিবাসীদের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। [সিফাতুল কাদের চৌধুরী এবং মাসুদ হাসান চৌধুরী]