চন্দ্র বংশ

চন্দ্র বংশ  দশ শতকের শুরু থেকে প্রায় দেড়শত বছর দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা (বঙ্গসমতট) শাসন করে। এ বংশের কয়েকজন শাসকের কয়েকটি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হওয়ায় বর্তমানে এঁদের বংশানুক্রমিক ইতিহাস পুনর্গঠন করা সম্ভব হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব অংশের ইতিহাসও হয়েছে যথেষ্ট আলোকিত যা আজ থেকে প্রায় ৫০/৬০ বছর আগেও বেশ অস্পষ্ট ছিল। তখন এ বংশের কেবল একজন শাসকের নামই (শ্রীচন্দ্র) জানা যেত। উত্তর ও পশ্চিম বাংলা এবং বিহারে যখন পালগণ শাসন করছিলেন তখন পাঁচ পুরুষ ধরে বঙ্গ ও সমতটে চন্দ্র বংশের যে শাসন অব্যাহত ছিল সে সম্পর্কে বর্তমানে প্রাপ্ত লিপি উৎসগুলি থেকে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে। চন্দ্রদের অধীনে বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব অংশের পৃথক রাজনৈতিক সত্ত্বার অস্তিত্ব প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে বর্তমানে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত।

পূর্ণচন্দ্র এবং সুবর্ণচন্দ্র হরিকেল রাজার অধীনে রোহিতাগিরির (সম্ভবত লালমাই অঞ্চল) সামন্ত ছিলেন। সুবর্ণচন্দ্রের পুত্র  ত্রৈলোক্যচন্দ্র (আনুমানিক ৯০০-৯৩০ খ্রি.) ছিলেন এ বংশের প্রথম স্বাধীন রাজা। তিনি সমতটে বংশের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন। দেবপর্বত ছিল তাদের ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল। বঙ্গের অংশ বিশেষ এবং চন্দ্রদ্বীপের উপর তিনি ধীরে ধীরে তাঁর ক্ষমতার বিস্তার ঘটান এবং ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি গ্রহণ করেন। লড়হচন্দ্রের ময়নামতী তাম্রশাসনের একটি শ্লোকে বলা হয়েছে যে, ত্রৈলোক্যচন্দ্রের অধীনে বঙ্গের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ঘটে। সমতটে ত্রৈলোক্যচন্দ্রের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয় খুব সম্ভবত পশ্চিম ও উত্তর বাংলায় পাল সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে কাম্বোজদের উত্থানের সমসাময়িককালে। ত্রৈলোক্যচন্দ্রের পুত্র ও উত্তরাধিকারী শ্রীচন্দ্রের (আনুমানিক ৯৩০-৯৭৫ খ্রি.) শাসনকালে চন্দ্র রাজ্যের প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপিত হয় বঙ্গের বিক্রমপুরে।

শ্রীচন্দ্র  ছিলেন চন্দ্র রাজবংশের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ রাজা। তিনি দীর্ঘ ৪৫ বছর শৌর্য-বীর্য ও সাফল্যের সঙ্গে রাজত্ব করেন। সমগ্র বঙ্গ অঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বে  কামরূপ পর্যন্ত চন্দ্রদের ক্ষমতা সম্প্রসারণের কৃতিত্ব শ্রীচন্দ্রের। মৌলভীবাজার জেলার পশ্চিমভাগ গ্রামে প্রাপ্ত তাঁর একটি তাম্রশাসনে কামরূপ অভিযান সম্পর্কে তথ্য রয়েছে। একই তাম্রশাসনে তাঁর উদ্যোগে সিলেট এলাকায় বিপুল সংখ্যক ব্রাহ্মণের বসতি স্থাপনের কথা জানা যায়। তিনি গৌড়দের বিরুদ্ধেও অস্ত্রধারণ করেন (খুব সম্ভবত কাম্বোজ গৌড়পতি বা পালদের বিরুদ্ধে)। দ্বিতীয় গোপাল-এর সময় পালদের ক্ষমতা রক্ষাকল্পে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন (পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনের একটি শ্লোকে দ্বিতীয় গোপালকে ‘গোপাল-সংরোপণে মহোৎসবগুরু’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে)। ভূমিদান সম্পর্কিত তাঁর ৬টি তাম্রশাসন এবং তাঁর উত্তরাধিকারীদের তাম্রশাসনে শ্রীচন্দ্র সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায় তা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে বঙ্গ ও সমতটের বিস্তীর্ণ এলাকায় তাঁর শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল।

শ্রীচন্দ্রের পুত্র ও উত্তরাধিকারী কল্যাণচন্দ্রের (আনুমানিক ৯৭৫-১০০০ খ্রি.) মাত্র ১টি তাম্রশাসন এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে। কল্যাণচন্দ্রের উত্তরাধিকারীগণের তাম্রশাসনসমূহ থেকে জানা যায়, কামরূপ এবং গৌড়ে তিনি ক্ষমতা প্রদর্শন করেছিলেন। উত্তর ও পশ্চিম বাংলায় কাম্বোজদের প্রতি তিনি সম্ভবত শেষ আঘাতটি করেন এবং প্রথম মহীপালর অধীনে পাল সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারে সাহায্য করেন। তাঁর দুজন উত্তরাধিকারী যথাক্রমে পুত্র লড়হচন্দ্র (আনুমানিক ১০০০-১০২০ খ্রি.) এবং পৌত্র গোবিন্দচন্দ্র (আনুমানিক ১০২০-১০৫০ খ্রি.) রাজ্যের গৌরব অব্যাহত রাখেন। অনুসৃত উদারনীতির কারণে তাদেরকে প্রশংসা করা হয়।

এ পর্যন্ত জানা মতে, গোবিন্দচন্দ্র ছিলেন চন্দ্র বংশের শেষ রাজা। তিরুমুলাই লিপিতে উল্লিখিত হয়েছে যে, তাঁর সময়ে ‘বঙ্গালদেশ’, বৃষ্টি যেখানে কখনও থামে না, চোলদের অভিযানে পর্যুদস্ত হয় (১০২১-১০২৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে)। সম্ভবত গোবিন্দচন্দ্র অথবা তাঁর উত্তরাধিকারী (নাম জানা যায় না) কলচুরি রাজা কর্ণ কর্তৃক (১০৪৮-৪৯ খ্রিস্টাব্দের আগে কোনো এক সময়) আক্রান্ত হয়েছিলেন। এ অভিযান চন্দ্রদের পতনের জন্য সম্ভবত যথেষ্ট দায়ী ছিল।

চন্দ্রগণ ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তাঁদের হাতেই ময়নামতী এবং লালমাই এলাকায় বৌদ্ধদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড নতুন শক্তি লাভ করে। কিন্তু চন্দ্রগণ উদার ধর্মীয় নীতি অনুসরণ করেছিলেন বলেই মনে হয়। সিলেট অঞ্চলে শ্রীচন্দ্র ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। শেষ দুজন চন্দ্ররাজারও বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল।  [আবদুল মমিন চৌধুরী]

গ্রন্থপঞ্জি  AM Chowdhury, Dynastic History of Bengal, Dhaka, 1967; RC Majumdar, History of Ancient Bengal, Calcutta, 1971.