গুরুদুয়ারা নানক শাহী

গুরুদুয়ারা নানক শাহী  শিখ সম্প্রদায়ের প্রধান উপাসনালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের অভ্যন্তরে প্রাক্তন সুজাতপুর মৌজায় এটি অবস্থিত। এক সময় এটি ‘সুজাতপুর শিখ সঙ্গত’ নামে পরিচিত ছিল। দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় ষষ্ঠ শিখগুরু হরগোবিন্দ সিং প্রেরিত শিখপুরোহিত আলমাস্তের প্রচেষ্টায় এটি নির্মিত বলে কথিত হয়। আলমাস্ত গুরু নানকের ধর্মমত ও শিক্ষা প্রচারের উদ্দেশ্যে ঢাকা আসেন এবং তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও ভক্তদের আর্থিক সহযোগিতায় গুরুদুয়ারা নির্মিত হয়। অপর একটি মতে এর নির্মাতা নবম শিখগুরু তেগ বাহাদুর সিং। এখান থেকে একটা সময় পর্যন্ত ঢাকাসহ বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার অন্যান্য শিখ মন্দিরের সঙ্গে ধর্মীয় ও প্রশাসনিক যোগাযোগ রক্ষা করা হতো।

গুরুদুয়ারা নানক শাহী, ঢাকা

অতীতে গুরুদুয়ারা নানক শাহীর উত্তরদিক দিয়ে একটি প্রবেশদ্বার ছিল। দক্ষিণ দিকের অংশে ছিল একটি কূপ ও সমাধিস্থল এবং পশ্চিমে ছিল একটি সান-বাঁধানো পুকুর। মূল মন্দির ছাড়াও ভক্তদের বসার জন্য ছিল কয়েকটি কক্ষ। সব মিলিয়ে কক্ষ ছিল মোট নয়টি। মূল উপাসনালয়ের উত্তর-পূর্ব দিকে ছিল অফিস ও আবাসিক ব্যবস্থা এবং পূর্বদিকে থাকতেন তত্ত্বাবধায়ক। সেসবের অনেক কিছুই বিনষ্ট হয়ে গেছে এবং সাম্প্রতিক কালে উপাসনালয়ের সংস্কার করা হয়েছে।

১৯১৫-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত শ্রীচন্দ্রজ্যোতি নামে এক শিখ সাধু এই মন্দিরে গ্রন্থির (পুরোহিত) দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ সালের পর থেকে ষাট দশক পর্যন্ত এটি ছিল প্রায় পরিত্যক্ত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এর পুনঃসংস্কার করা হয়। বর্তমানে ভাই পিয়্যারা সিং গুরুদুয়ারার প্রধান গ্রন্থি। তিনি ১৯৯২ সাল থেকে এ দায়িত্ব পালন করছেন।

গুরুদুয়ারায় কারও প্রবেশে বাধা নেই। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই মন্দিরে প্রবেশ করে প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করতে পারে। প্রার্থনাস্থলকে বলা হয় ‘দরবার সাহেব’। এর চতুর্দিক দিয়ে ভেতরে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। গুরুদুয়ারা উপাসনালয়ের প্রবেশ দ্বারের সংখ্যা সাধারণত অন্যান্য ধর্মের উপাসনালয়ের চেয়ে বেশি থাকে। উপাসনা কক্ষের উত্তর প্রান্তে কাঠের তৈরি একটি বেদিতে শিখধর্মগ্রন্থ গ্রন্থসাহেব রাখা আছে। নবম শিখগুরু তেগ বাহাদুর সিং-এর ব্যবহূত একজোড়া কাঠের খড়মও গ্রন্থসাহেবের নিম্নভাগে একটি কাঁচের বাক্সে সসম্মানে সংরক্ষিত আছে।

গুরু নানক শাহীর প্রাত্যহিক ধর্মাচরণের মধ্যে রয়েছে সকাল-সন্ধ্যা গ্রন্থসাহেব পাঠ ও প্রার্থনা (আরদাস)। এছাড়া প্রতি শুক্রবার সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত সাপ্তাহিক জমায়েত ও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান পুরোহিত গ্রন্থপাঠ করার পাশাপাশি কীর্তনও করেন। কীর্তনে তবলা, ডুগডুগি, খাকসা, হারমোনিয়াম ইত্যাদি যন্ত্র ব্যবহূত হয়। প্রায় দুই-আড়াই ঘণ্টা কীর্তন ও প্রার্থনা চলে। প্রার্থনা শেষে স্তোত্রপাঠ ও প্রসাদ বিতরণ করা হয়। এখানে প্রাতঃভোজেরও ব্যবস্থা আছে এবং সেজন্য আছে একটি ‘গুরুকা লঙ্গর’ বা ভোজনালয়। শিখরা এই ভোজকে সৌহার্দ্য বৃদ্ধির সহায়ক বলে মনে করে।

গুরুদুয়ারা পরিচালনার জন্য আছে ‘বাংলাদেশ গুরুদুয়ারা ম্যানেজমেন্ট বোর্ড’। এতে দেশি-বিদেশি সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। স্থানীয় প্রশাসনের জন্য রয়েছে ‘বাংলাদেশ গুরুদুয়ারা ম্যানেজমেন্ট কমিটি’। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় আট-নয়টি ক্ষুদ্রায়তনের গুরুদুয়ারা রয়েছে। সেগুলির প্রধান কেন্দ্র এই গুরুদুয়ারা নানক শাহী। স্থানীয় ভক্ত, বিদেশি অভ্যাগত ও দাতা সংস্থার সাহায্য এবং বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক অনুদানে এর খরচ নির্বাহ হয়।  [সমবারু চন্দ্র মহন্ত]

আরও দেখুন শিখধর্ম