গভর্নরের পাক্ষিক প্রতিবেদন

গভর্নরের পাক্ষিক প্রতিবেদন  গভর্নর কর্তৃক ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেলের নিকট পাক্ষিক প্রতিবেদন প্রেরণের রীতিটি ১৯৩৫ সালের  ভারত শাসন আইন-এর অধীনে প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের একেবারে সূচনা থেকে লডট্ট লিনলিথগো (১৯৩৬-১৯৪৩) প্রবর্তন করেন। ১৯৪৭ সালে চূড়ান্তভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় পর্যন্ত এ নিয়মটি অব্যাহত ছিল। পাক্ষিক প্রতিবেদন বিবেচিত হতো অত্যন্ত গোপনীয়, একান্ত বা ব্যক্তিগত দলিল হিসেবে। এটি সরাসরি লন্ডনে ভারত সচিবের কাছে প্রেরিত হতো এবং শেষ পর্যন্ত ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি অ্যান্ড রেকর্ডস অফিসে জমা থাকত। প্রতিবেদন লন্ডনে পৌঁছা মাত্রই তা বিশদভাবে পর্যালোচনা করা হতো এবং এ পর্যালোচনায় বহু ইঙ্গিত ও মন্তব্য বেরিয়ে আসত, যা ছিল সাম্রাজ্যিক প্রক্রিয়ার প্রতিফলন। আদিতে পাবলিক ও জুডিশিয়াল এ দ’ুশ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে সংরক্ষিত হলেও বর্তমানে এ দলিলগুলি গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।

বাংলা প্রদেশে ব্রিটিশ রাজের সর্বোচ্চ প্রতিনিধি গভর্নর তাঁর পাক্ষিক প্রতিবেদনে বিভিন্ন ঘটনা, বিষয় ও ইস্যু অন্তর্ভুক্ত করতেন, যা তাঁর বিবেচনায় প্রাদেশিক বিষয় এবং অন্যান্য সাম্রাজ্যিক বিষয়ে ভাইসরয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো। এ প্রতিবেদনের মূল লক্ষ্য ছিল প্রদেশের রাজনৈতিক উন্নয়ন, বিশেষকরে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্পর্কিত। এ ছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেগুলি অন্যথা উল্লিখিত হয় নি বা সেগুলি সম্পর্কে কোনো প্রতিবেদন দেওয়া হয় নি, সেসব বিষয়ের প্রধান প্রধান অংশের ওপর রিপোর্ট প্রদান। এ রুটিন মাফিক আমলাতান্ত্রিক কাজের প্রকৃতি ভারতে বিশেষকরে বাংলায় ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন দিক ও এর জটিল অবকাঠামো উপস্থাপন করে।

প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন বলবৎ হওয়ার পর শ্রেণিবহির্ভুত বার্ষিক প্রকাশনা রিপোর্ট অন দি অ্যাডমিনিসট্রেশন অব বেঙ্গল-এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বিভাগীয় বার্ষিক প্রতিবেদন এবং জনস্বার্থের অন্যান্য সাময়িক দলিলপত্রাদি ছাড়া প্রদেশের যে কোনো প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন ব্যাপারে সাধারণের জ্ঞাত হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়। যেহেতু গভর্নরের পাক্ষিক প্রতিবেদন ছিল ‘টপ সিক্রেট’, তাই সে সময়ের সাধারণ জনগণ ও রাজনীতিবিদদের পক্ষে ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের কর্মকান্ড ও প্রকৃতি সম্পর্কে জানার কোনো সুযোগই ছিল না। এতে বিশেষ অসুবিধার সৃষ্টি হয়। আর স্বাভাবিকভাবেই প্রশাসনিক পলিসি আর খোলাখুলি থাকে নি।

গভর্নরের প্রতিবেদনের সাথে সংযুক্ত ছিল চিফ সেক্রেটারির কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্ট, প্রেস অফিসারের রিপোর্ট, অস্থায়ী কমিশনারের রিপোর্ট এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার ডেপুটি কমিশনারের মাসিক রিপোর্ট। ১৯৩৬ সালের ১৭ অক্টোবর গভর্নরের প্রথম প্রতিবেদন বের হয় এবং শেষ প্রতিবেদনটি পাঠানো হয় ১৯৪৭ সালের ১২ আগস্ট।

উল্লেখ্য যে, যদিও পাক্ষিক প্রতিবেদনগুলি ‘সর্বাত্মকভাবে স্পষ্ট’ রিপোর্ট প্রদানে সচেষ্ট হওয়ার কথা, তথাপি সেগুলিতে শুধু সরকারি ভাষ্য অথবা শুধু ব্রিটিশ দৃষ্টিভঙ্গিই প্রকাশ পেত। বহু ঘটনা ও বিষয়ের সম্মুখীন হতে হলেও সাম্রাজ্যিক স্বার্থে গভর্নরের প্রতিবেদনে শুধু সে বিষয়গুলিই স্থান পেয়েছে যেগুলি ধারাবাহিকভাবে আগ্রহ সৃষ্টি করেছে বা তাৎক্ষণিক গুরুত্ব পেয়েছে। গভর্নরগণ হিন্দু বাঙালিদের কুফলদায়ক, ষড়যন্ত্রমূলক ও ভন্ডামিপূর্ণ ‘সম্ভ্রান্ত শ্রেণির রাজনীতি’ সম্পর্কে অত্যন্ত সোচ্চার ছিলেন। দেখা যায় যে, পাক্ষিক প্রতিবেদনে গভর্নরের সহানুভূতি ছিল ব্রিটিশ অনুগত মুসলমানদের প্রতি।

যদিও প্রতিবেদনগুলি সাম্রাজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিল, তথাপি এগুলি বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনে প্রাথমিক উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ উৎস বটে।  [এনায়েতুর রহিম]