ক্ষালিত বস্ত্ত

ক্ষালিত বস্ত্ত (Leachate)  পয়ঃভান্ডার থেকে তরলের মাধ্যমে বিশেষ করে পানির সাহায্যে মুক্ত হওয়া দ্রবীভূত রাসায়নিক অপদ্রব্যসমূহ। সাধারণভাবে পরিবেশে এসকল অপদ্রব্যসমূহের ক্ষতিকর প্রভাব যথাসম্ভব হ্রাস করার লক্ষ্যে পয়ঃশোধনাগার নির্মাণ করে সেখানে এসকল ক্ষতিকর পদার্থ নিক্ষেপ করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ পয়ঃশোধনাগার নির্মাণের কারণে ছিদ্রপথে তরল বর্জ্যসমূহ ভূগর্ভে অনুপ্রবেশ করে যাদেরকে ক্ষালিত বস্ত্ত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এসকল ক্ষালিত বস্ত্ত মৃত্তিকা স্তরের মধ্য দিয়ে অনুপ্রবেশ করে ভূগর্ভস্থ পানিকে দূষিত করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে, নিচু স্থানে ভরাটকৃত বর্জ্য পদার্থসৃষ্ট ক্ষালিত বস্ত্ত হচ্ছে এক ধরনের তরল যা বর্জ্যের তরল অংশ থেকে উৎপন্ন হয়। বৃষ্টির পানি অথবা ভূগর্ভস্থ জলস্তরের নিচে বর্জ্য পদার্থসমূহ সঞ্চিত হলে  ভূগর্ভস্থ পানি এ সঞ্চিত বর্জ্যের মধ্য দিয়ে চুইয়ে ভেতরে প্রবেশ করে বর্জ্যের সঙ্গে মিশ্রিত হয় এবং বর্জ্যের জৈব ও অজৈব পদার্থসমূহকে দ্রবীভূত করে তরল ক্ষালিত বস্ত্ত উৎপন্ন করে।

ক্ষালিত বস্ত্তসমূহ দ্রবীভূত ও কলয়েডীয় জৈবপদার্থ (colloidal organic matter) এবং অজৈব যৌগ ও আয়নের জটিল মিশ্রণ দ্বারা গঠিত। নিচু ভূমি ভরাটের ক্ষেত্রে নিক্ষিপ্ত বর্জ্য পদার্থের মধ্যে সাধারণত পৌর আবর্জনা, দালান-কোঠার ধ্বংসস্ত্তপ, পয়ঃতরল শোধন প্লান্ট থেকে উৎপন্ন বর্জ্য, দহন চুল্লী থেকে উৎপন্ন ভষ্ম, ঢালাই কারখানাসৃষ্ট গুঁড়া পদার্থ ও অন্যান্য বর্জ্য এবং নানা ধরনের বিষাক্ত ও ক্ষতিকারক পদার্থ অন্তর্ভুক্ত থাকে। ক্ষালিত বস্ত্তর পরিমাণ হ্রাসের লক্ষ্যে আধুনিক পৌর আবর্জনা নিক্ষেপ ক্ষেত্রসমূহ অথবা বর্জ্য দ্বারা ভরাটকৃত নিচু স্থানসমূহ কয়েকটি স্তরে বিভক্ত করে ভরাট করা হয়ে থাকে। প্রতিটি স্তরে বর্জ্য পদার্থসমূহ নিক্ষেপশেষে যত দ্রুত সম্ভব এর উপরে নিম্ন প্রবেশ্যতাবিশিষ্ট একটি আবরণ স্থাপন করা হয় যাতে বৃষ্টির পানির অনুপ্রবেশ রোধ করা যায় বা খুবই সীমিত হয়। এ ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াও বর্তমান সময়কালের পৌর আবর্জনা নিক্ষেপের স্থানসমূহে নিম্ন প্রবেশ্যতাবিশিষ্ট লাইনার ব্যবহার করা হয় এবং উৎপন্ন ক্ষালিত বস্ত্তসমূহ অপসারণের উদ্দেশ্যে নল সংযুক্ত থাকে। এ নলের মাধ্যমে ক্ষালিত বস্ত্তসমৃদ্ধ পানি অপসারণ করে শোধনের জন্য প্লান্টে পাঠানো হয়। স্থানীয় ভূতত্ত্ব বিবেচনায় রেখে যথার্থ স্থানে স্থাপিত এবং সঠিকভাবে নকশাকৃত ও লাইনার নির্মিত একটি বর্জ্য ভান্ডারে ক্ষালিত বস্ত্ত সংগ্রহের ব্যবস্থা ও নিম্ন প্রবেশ্যতা আবরক থাকার ফলে এ ধরনের বর্জ্য ভান্ডার খুবই সামান্য পরিমাণে ভূগর্ভস্থ পানির দূষণ ঘটিয়ে থাকে।

বাংলাদেশে বড় বড় শহরের পৌর আবর্জনা নিক্ষেপের স্থানসমূহ থেকে ক্ষালিত বস্ত্ত সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া শিল্প কারখানাসমূহ থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ক্ষালিত বস্ত্ত সৃষ্টি হয়ে থাকে। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য বড় শহরগুলিতে সাধারণত শহরের আশপাশের নিচু এলাকাসমূহে পৌর আবর্জনা নিক্ষেপ করা হয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে ভূমি ভরাট প্রক্রিয়ার কোনো আদর্শ রীতি অনুসরণ করা হয় না। পৌর আবর্জনা থেকে সৃষ্ট ক্ষালিত বস্ত্তসমূহে উচ্চমাত্রার ক্লোরিনযুক্ত হাইড্রোকার্বন দ্রাবক (সি.এইচ.এস) বিদ্যমান থাকে যেগুলি খুবই বিষাক্ত এবং পচনশীল ক্ষতসৃষ্টিকারী জীবাণুবাহী। এতদসত্ত্বেও ঢাকা মহানগরীর ভূগর্ভস্থ পানিতে ক্ষালিত বস্ত্ত দূষিত সি.এইচ.এস শনাক্তকরণের লক্ষ্যে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ব্যাপক মাত্রার গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয় নি। তবে সাম্প্রতিক কিছু কিছু অনুসন্ধানে হাজারিবাগ ও তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানিতে বর্জ্যসৃষ্ট ক্ষালিত বস্ত্ত দ্বারা দূষণক্রিয়ার ঘটনা ধরা পড়েছে এবং সে সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানিতে বেশকিছু সি.এইচ.এস উপাদান চিহ্নিত করা গিয়েছে। একই ধরনের দূষক পদার্থ দেশের অন্যান্য বড় শহর ও শিল্প এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে অনুপ্রবেশ করে পানিকে দূষিত করাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এ সংক্রান্ত কোনো তথ্যপ্রমাণ এখন পর্যন্ত নেই। [সিফাতুল কাদের চৌধুরী]