কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ

কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন সাহিত্য সংস্থা। ১৯৩৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর হযরত শাহজালাল (র.)-এর দরগা শরিফের সরেকওম হাউজে কয়েকজন সাহিত্যামোদী একটি সাহিত্য সমিতি গঠনের লক্ষ্যে এক সভায় মিলিত হন। আসামের তৎকালীন এম এল এ আশরাফ উদ্দিন মোহাম্মদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভার সিদ্ধান্ত মতে ওইদিন সিলেট মুসলিম সাহিত্য সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়। সংসদের প্রথম সভাপতি খানবাহাদুর দেওয়ান একলিমুর রাজা চৌধুরী এবং প্রথম সম্পাদক এ জেড আবদুল্লাহ। সংসদের গঠনতন্ত্রে এর মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘মুসলমান সমাজে সাহিত্যচর্চার ব্যাপক প্রচলন, বৃহত্তর সিলেটের বাংলা ভাষাভাষী অজ্ঞাতনামা কবি ও সাহিত্যিকগণের রচিত সাহিত্য সংকলন, প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ এবং মুসলিম সাহিত্যসেবীবৃন্দের সাহিত্যচর্চার সুযোগ প্রদানই এই সংসদের মুখ্য উদ্দেশ্য।’ ১৯৩৭ সালের ৪ অক্টোবর সংসদের একটি বিশেষ সভায় কবি জসীমউদ্দীন প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করেন। ১৯৩৯ সালের ১৪ মে সংসদের দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন সৈয়দ মুজতবা আলী। দ্বিতীয় বার্ষিক সাধারণ সভায় আল ইসলাহ সম্পাদক মুহম্মদ নূরুল হক সংসদের সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। আমৃত্যু (১৯৮৭) তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আসাম সরকার সংসদকে বার্ষিক মঞ্জুরী প্রদান করেছেন। ১৯৩৯ সালে মুসলিম সাহিত্য সংসদের শিলং শাখা; ১৯৪০ সালের ১ ডিসেম্বর কলকাতার ২৪ নং জাকারিয়া স্ট্রিটে সংসদের কলকাতা শাখা গঠিত হয়। তাই প্রতিষ্ঠানটির নাম কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ রাখা হয়। শাখাগুলি ১৯৪৭ সালে বন্ধ হয়ে গেলে এবং পরে আর কোথাও শাখা গঠিত না হলেও সংসদের নাম আর পরিবর্তিত হয়নি।

১৯৩৯ সালের ২৮ জুন সংসদের সিদ্ধান্তক্রমে কতিপয় শর্তসাপেক্ষে সংসদ সম্পাদক মুহম্মদ নূরুল হক তৎপ্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত মাসিক আল ইসলাহকে সংসদের কাছে হস্তান্তর করেন। তখন থেকে এখন পর্যন্ত (সাময়িক বিরতিসহ) এই সাহিত্য পত্রিকাটি কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে। সংসদের নিজস্ব অফিসের উদ্বোধন হয় ১৯৩৯ সালের ৯ নভেম্বর। ১৯৪৭ সালের ৯ নভেম্বর সংসদ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে। শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার পক্ষে সাহসী অভিমত ব্যক্ত করেন। ১৯৪৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর সংসদে ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ প্রবন্ধ পাঠ করেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ।

সৈয়দ আবদুল মজিদ সি আই ই-এর প্রচেষ্টায় ১৯১২ সালে হযরত শাহ জালাল (র.)-এর দরগাহের মূল ফটকের দক্ষিণ পাশে আঞ্জুমানে ইসলামিয়ার জন্য মুসলিম হল গড়ে ওঠে। ১৯৪৯ সালে মুসলিম হলের নতুন ভবন নির্মিত হলে এর নামকরণ হয় জিন্নাহ হল। ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জিন্নাহ হল কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদকে প্রদান করা হয়। ১৯৭২ সালে হলের নাম রাখা হয় শহীদ সোলেমান হল। বর্তমানে মূল একতলা হল ভেঙ্গে চারতলা ভবন নির্মাণের কাজ চলছে এবং পাশে নবনির্মিত তিনতলা ভবনে সংসদের কার্যক্রম চলছে। মাত্র ১৭ টি বই নিয়ে সংসদের লাইব্রেরি গড়ে উঠেছিল। বর্তমানে এর পুস্তক সংখ্যা বিয়াল্লিশ হাজার। এছাড়া সংসদে সংরক্ষিত আছে দেড় হাজার দুষ্প্রাপ্য পুস্তক; পঞ্চাশটি পান্ডুলিপি, প্রাচীন পত্রপত্রিকা, মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের হাতে লেখা কোরান শরিফ এবং অন্যান্য প্রত্নসামগ্রী।

১৯৩৬ থেকে ১৯৮৭ সালের মধ্যে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ চারটি সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করেছে। ১৯৩৬, ১৯৩৮ ও ১৯৪০ সালে তিনটি সাহিত্য সম্মেলন হয়েছে। ১৯৬১ সালের ২৮, ২৯ ও ৩০ জুলাই কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে অনুষ্ঠিত হয় নজরুল সাহিত্য সম্মেলন। ২০০১ সাল থেকে প্রায় প্রতি বছর সংসদ সাহিত্য সম্মেলন ও বইমেলার আয়োজন করে। প্রতি বৃহস্পতিবারে অনুষ্ঠিত হয় সাহিত্য সভা। ২০০০ সালে প্রবর্তিত হয়েছে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ সাহিত্য পুরস্কার। প্রতি দু বছর অন্তর পুরস্কার প্রদান করা হয়। এ পর্যন্ত ৬জন খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিক এ পুরস্কার লাভ করেছেন। কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ কয়েকখানা গ্রন্থও প্রকাশ করেছে। খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিক, মন্ত্রী এবং বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতগণ সংসদ পরিদর্শন করেছেন। সংসদ লাইব্রেরি গবেষকদের গবেষণা করার জন্য বিশেষ সহযোগিতা প্রদান করে। সংসদে বর্তমানে ১৩৭জন পৃষ্ঠপোষক, ১২৫৭জন আজীবন সদস্য ও ৯৮জন সাধারণ সদস্য রয়েছেন। সংসদের বর্তমান সভাপতি রাগিব হোসেন চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক হারুনুজ্জামান চৌধুরী। বার্ষিক সাধারণ সভায় দুই বছর মেয়াদের জন্য কার্যকরী পরিষদের ২৩জন কর্মকর্তা নির্বাচিত হন। [নন্দলাল শর্মা]