এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা

এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা (১৭৮৪)  বৈজ্ঞানিকভাবে এশীয় সভ্যতা, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া, অধ্যয়নের জন্য প্রথম পান্ডিত্যপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। স্যার উইলিয়ম জোনস্ (১৭৪৬-১৭৯৪), যিনি ১৭৮৩ সালে কলকাতা সুপ্রীম কোর্টে কনিষ্ঠ বিচারক হিসেবে যোগদান করেন, সর্বপ্রথম সার্বিকভাবে এশিয়া এবং বিশেষভাবে দক্ষিণ এশিয়ার উপর পদ্ধতিগত গবেষণা পরিচালনার জন্য একটি সমিতি প্রতিষ্ঠার ধারণা দেন। ইতোমধ্যে নাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড, চালট্টস উইলকিন্র, এইচ.টি. কোলব্রুকসহ বেশ কয়েকজন কোম্পানি কর্মচারী সক্রিয়ভাবে প্রাচ্যদেশীয় অধ্যয়নে জড়িত হয়ে পড়েন। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস স্বয়ং ভারতীয় ক্ল্যাসিক্যাল ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি গভীর আগ্রহী ছিলেন। সুতরাং প্রাচ্যবিদ্যা অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে একটি নিয়মিত সংস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য জোনসের প্রস্তাব ফোর্ট উইলিয়ম এর অন্যান্য সহকর্মীদের নিকট থেকে জোরালো সমর্থন লাভ করে।

এশিয়াটিক সোসাইটি ভবন , কলকাতা

১৭৮৪ সালের ১৫ জানুয়ারি সমমনা ৩০ জন উৎসাহী ইউরোপীয় ব্যক্তিত্ব কলকাতা সুপ্রীম কোর্টের গ্রান্ড জুরি কক্ষে এক বৈঠকে মিলিত হন এবং এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে জোনসের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এ প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হয়, ‘দি এশিয়াটিক সোসাইটি’ (The Asiatick Society)। উইলিয়ম জোনস এর প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৭৯৪ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংসকে এ প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক করা হয়। তখন থেকে পৃষ্ঠপোষকের আসনটি গভর্নর জেনারেলের জন্য নির্ধারিত ছিল। পরবর্তীসময়ে বাংলার গভর্নর এ আসন লাভ করেন এবং ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল।

সোসাইটির প্রথম সচিব নির্বাচিত হন জর্জ হিলারো (George Hillarow)। জ্ঞান চর্চায় আগ্রহী যে কোনো ইউরোপীয় ব্যক্তি এ প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ লাভের জন্য আবেদন করতে পারতেন। শিক্ষিত দেশিয়দের জন্য এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্যপদ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় ১৮২৯ সালে। এসময় তাঁদের মধ্যে ৫ জন সদস্য নির্বাচিত হন। এঁরা হলেন- প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, দ্বারকানাথ ঠাকুর, শিবচন্দ্র দাস, রসময় দত্ত এবং রাম কমল সেন। তখন থেকে ধর্ম, সম্প্রদায়, বর্ণ নির্বিশেষে সকল জাতির লোকজনের জন্য এ প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

সোসাইটির নাম এবং প্রকাশনা সিরিজের নাম নিয়ে যথেষ্ট বিভ্রান্তি ছিল। আদি নাম ছিল ‘Asiatick Society’, ১৮২৫ সালে নাম থেকে আগেকার ‘k’ বাদ দেওয়া হয় এবং তখন থেকে এর নাম হয় ‘Asiatic Society’। ১৮৩২ সাল থেকে জৈমস্প্রিন্সেপ-এর সম্পাদনায় ‘Journal of the Asiatic Society of Bengal’ প্রকাশিত হতে থাকে। এটি একটি ব্যক্তিগত উদ্যোগ হলেও এতে প্রধানত এশিয়াটিক সোসাইটির গবেষণা প্রতিবেদনগুলিই প্রকাশিত হতো। ১৮৪২ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি স্বীয় সাময়িকী হিসেবে প্রিন্সেপের জার্নালের স্বত্ব লাভ করে। কিন্তু এর শিরোনাম অক্ষুণ্ণ থাকে। এর ফলে প্রতিষ্ঠান এবং এর জার্নালের নামের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। ১৮৯৯ সালে সোসাইটির নাম পরিবর্তন করে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল’ করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। কিন্তু সাধারণ পরিষদের ভোটে সে প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। ১৯৩৬ সালে একটি রাজকীয় সনদ অর্জনের মাধ্যমে সোসাইটির নতুন নাম হয় ‘দি রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল’। ১৯৫০ সালের ২ জানুয়ারি এক সাধারণ সভায় সোসাইটির নাম পুনরায় ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ করা হয়।

সোসাইটির জার্নালের শিরোনাম নিয়েও বিভ্রান্তি ছিল। এর অদাপ্তরিক জার্নাল Asiatick Researches ১৭৮৮ থেকে ১৮৪৯ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। ‘The Journal of the Asiatic Society of Bengal’ ১৮৩২ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। ১৯৩৫ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত এর নাম ছিল ‘Journal of the Royal Asiatic Society of Bengal’। ১৯৫৩ সাল থেকে এ জার্নাল ‘Journal of the Asiatic Society’ নামধারণ করে।

সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন এবং প্রভাবশালী প্রকাশনা হচ্ছে Bibliotheca Indica সিরিজের অধিনে প্রাশিত প্রকাশনা। এতে সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, বাংলা, তিববতি এবং অন্যান্য এশীয় ভাষা ও তার অনুবাদ সমূহের বিস্ময়কর ধারাবাহিক প্রাচ্য বিষয়ক রচনা ধারণ করা হয়েছে। সোসাইটির লাইব্রেরী, আর্কাইভস এবং মিউজিয়ামের রয়েছে সমৃদ্ধ সংগ্রহ।

বর্তমানে কলকাতার ১, পার্ক স্ট্রীটে অবস্থিত এশিয়াটিক সোসাইটি ভারতের অতীত উদ্ঘাটনে পথ প্রদর্শকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ প্রায় সবটাই এশিয়াটিক সোসাইটির অবদান। উইলিয়ম জোনস, চার্লস উইলকিন্স, এইচ.টি. কোলব্রুক, বি.এইচ. হডসন, ফ্রান্সিস উইলফোর্ড, স্যামুয়েল ডেভিস, এইচ.এইচ.উইলসন, জেমস প্রিন্সেপ, এ্যাডওয়ার্ড ফেল, হেনরী ফার্ডিনান্ড ব্লকম্যান , স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম , হৈনরী বেভারীজ প্রমুখ ভারত ও প্রাচ্য বিশারদগণ এশিয়াটিক সোসাইটিতে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিস্ময় সৃষ্টি করেছিলেন। এ সোসাইটি তার প্রকাশনা ও জার্নাল যেমন Asiatick Researches, Gleanings in Sciences এবং Journal of the Asiatic Society of Bengal ও অন্যান্য বিভিন্ন ধরণের আত্মজীবনী-এর মাধ্যমে অনুসন্ধিৎসামূলক গবেষণা চালানোর জন্য তাঁদের একটি ফোরাম তৈরি করে দিয়েছিলো। সোসাইটির বিবরণী এবং প্রকৃত প্রকাশনা থেকে অতীতের ধ্বংসাবশেষ থেকে আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস পুনর্নির্মাণে এর ভূমিকার কথা জানা যায়।

১৮১৪ সালে ডেনমার্কের উদ্ভিদতত্ত্ববিদ ড. নাথানিয়াল ওয়ালিক এশিয়াটিক সোসাইটিতে একটি জাদুঘর স্থাপনের প্রস্তাব করেন। তার প্রস্তাব অনুসারে ১৮১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সোসাইটিতে জাদুঘর স্থাপন করা হয়। ওয়ালিক ছিলেন জাদুঘরের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক। এই জাদুঘরের একাধিক বিভাগ সমূহের মধ্যে ছিলো- প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব এবং প্রাণীতত্ত্ব। ভারতীয় এবং ইউরোপীয় দাতাদের কাছ থেকে আর্টিকেল সংগ্রহের মাধ্যমে তিনি এই জাদুঘরকে সমৃদ্ধ করেন। বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় তাদের ব্যক্তিগত সংগ্রহসমূহ জাদুঘরে দান করেন। ভারতীয়দের মধ্যে, রাম কমল সেন, বেগম সমরু, কালিকৃষ্ণ বাহাদুর, মথুরানাথ মল্লিক, রাধাকান্ত দেব এবং রাজেন্দ্রলাল মল্লিক প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ তাঁদের সংগ্রহসমূহ জাদুঘরের জন্য দান করেন। ১৮১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে সোসাইটির আর্ট গ্যালারি উদ্বোধন হয়। ১৮৪১ সালে সোসাইটিতে অর্থনৈতিক ভূতত্ত্ব জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়। সোসাইটির এ সকল সংগ্রহ পরবর্তী সময়ে ১৮৬৬ সালে স্থাপিত কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম এর প্রাথমিক সংগৃহীত সামগ্রীতে পরিণত হয়।

এশিয়াটিক সোসাইটির কার্যবিবরণী সর্বপ্রথম ১৭৮৮ সালে ‘এশিয়াটিক রিসার্সেস’ (Asiatick Researches) শিরোনামে প্রকাশিত হলেও সোসাইটির মাধ্যমে তাদের জার্নাল তখনো প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু একটি ব্যক্তিগত উদ্দোগ হিসেবে ইউরোপীয় বিজ্ঞজন এবং বিজ্ঞানি সমাজে ‘এশিয়াটিক রিসার্সেস’-এর গুরুত্ব অনুধাবিত হয় ও তা বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। কারণ এ প্রকাশনার মাধ্যমেই ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শন এবং এর মহিমা প্রথমবারের মত প্রকাশিত হয়। গবেষণা এবং আবিষ্কারের মাধ্যমে এশিয়াটিক সোসাইটি ইউরোপ এবং আমেরিকার অন্যান্য গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানের সংস্পর্শে আসে। এশিয়াটিক সোসাইটি ইতিহাস, ভাষা, সাহিত্য, ফোকলোর, শব্দকোষ, রীতিনীতি ও প্রথা, ধর্ম, সঙ্গীত, নৃতত্ত্ব, পদার্থবিদ্যা, আবহবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, উদ্ভিদ জীবাশ্মবিদ্যা, ভূগোল সহ আরও অন্যান্য বিষয়ে অনুসন্ধিৎসুমূলক গবেষণা করে। জ্ঞানের ক্ষেত্রে এশিয়াটিক সোসাইটির সবচাইতে বড় অবদান ছিলো ভাষাতত্ত্বের প্রয়োগ যা প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার ক্ষেত্র তৈরি করেছিলো। এশিয়াটিক সোসাইটি ১৮৪৮ সাল থেকে সোসাইটির ‘Bibliotheca Indica সিরিজের মাধ্যমে প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় ঐতিহ্যগত বিষয়ের সম্পাদিত বিষয়সমূহের প্রকাশনা শুরু করে। প্রাচ্য বিষয়ক জ্ঞান সমৃদ্ধকরণে এই সিরিজের অবদান ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, গোটা বিশ্বে বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন ধারায় এশিয়াটিক সোসাইটির বড় ধরনের প্রভাব পড়েছিল। মানবজাতির কল্যানের বিষয় অধ্যয়নে প্রাচ্যবাদ, সভ্যতার ব্যাখ্যায় একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়। সভ্য বিশ্বের অন্যান্য অংশেও  এশিয়াটিক সোসাইটির মত একই শিরোনামে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে। ১৮২৯ সালে Royal Asiatic Society of Great Britain প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘বোম্বে রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি’ নামে বোম্বেতে এর একটি শাখা ছিলো। শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, টোকিও এবং আমেরিকা (ভিন্ন নামে Oriental Academy), এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তানে (বর্তমানের বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি) এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

সোসাইটির সাংগঠনিক কাঠামো গ্রহণ করা হয় রয়াল সোসাইটি থেকে এবং মোটামুটি এখনও তা অনুসরণ করা হচ্ছে। শুরু থেকেই এর একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং সবসময়ই তিনি ছিলেন রাষ্ট্রের প্রধান। অতীতের মতোই বর্তমানে সোসাইটির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি পরিষদ রয়েছে। এতে একজন সভাপতি, একজন সহ-সভাপতি, একজন কোষাধ্যক্ষ এবং বিভিন্ন শৃঙ্খলার দায়িত্বে কয়েকজন অতিরিক্ত সদস্য রয়েছেন। সোসাইটি সদস্য, সম্মানিত সদস্য, সহযোগী সদস্য এবং বিনিময় (Corresponding) সদস্য পদ প্রদান করে থাকে। পরিষদ ফেলোশিপের জন্য কৃতিত্বপূর্ণ প্রাচ্যদেশীয় পন্ডিতদের নির্বাচন করে থাকে। মাসিক সভায় সোসাইটির কাজকর্ম সম্পাদন করা হয়। সদস্যরা এক বছরের জন্য পর্ষদ নির্বাচন করেন। বর্তমানে ১৯৮৪ সালের এশিয়াটিক সোসাইটি অ্যাক্টের অধীনে কেন্দ্রীয়ভাবেও সরকার এ সোসাইটিকে অর্থায়ন করে যাচ্ছে। এ অ্যাক্টের ঘোষণায় বলা হয় ‘কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইন্সটিটিউশন’।  [সিরাজুল ইসলাম]