ঋণ শ্রেণীবিন্যাসকরণ

ঋণ শ্রেণিবিন্যাসকরণ  স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের  ব্যাংক ব্যবস্থা দীর্ঘ সময়ব্যাপী একটি নির্দেশিত ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পরিচালিত হয়েছে। বিশেষভাবে চিহ্নিত অগ্রাধিকার খাতসমূহে সরকার কর্তৃক নির্দেশিত সুদে ব্যাংকগুলিকে ঋণদানে বাধ্য করা হতো। ফলে এ সকল নির্দেশিত ঋণের বৃহদাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ ও অনাদায়ী হয়ে পড়ে। কিন্তু ঋণসমূহ পরিশোধ কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে গণ্য করার জন্য কোনো সুসমন্বিত সময়সূচি এবং সেগুলিকে শ্রেণিবিন্যাস্ত করার মানসম্পন্ন কোনো পদ্ধতি ও নীতিমালা ছিল না। ফলে স্বাধীনতা পরবর্তী আড়াই দশকেরও বেশি সময় বাংলাদেশে ঋণ শ্রেণিবিন্যস্ত করার বিষয়টি প্রচলিত ছিল না। সাধারণত কোনো একটি ঋণকে শ্রেণিবিভাজিত বলে গণ্য করার জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হতো। ফলে ঋণ শ্রেণিবিন্যাস্ত করার ধারণা এদেশে ততটা গুরুত্ব পায় নি। ফলে ব্যাংকগুলির প্রদত্ত ঋণের অধিকাংশ অ-কার্যকর ও অনাদায়ী হয়ে পড়ে এবং তারা ব্যাপকভাবে মূলধন ঘাটতির সম্মুখীন হয়। কালক্রমে দেশের গোটা ব্যাংক ব্যবস্থা দায় পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়ে এবং ফলে ভবিষ্যৎ কার্যক্রম চালানো অসম্ভব বলে পরিলক্ষিত হয়। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিশন অন মানি, ব্যাংকিং অ্যান্ড ক্রেডিট এবং বিশ্ব ব্যাংকের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার আর্থিক খাত সংস্কারের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেয়। এ সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাসে ঋণ শ্রেণিবিন্যাসকরণের একটি নতুন পদ্ধতি এবং সম্ভাব্য অনাদায়ী ও লোকসানি ঋণসমূহের ওপর ব্যাংকগুলির অর্জিত মুনাফা থেকে সঞ্চয় সংরক্ষণের নিয়ম চালু করা হয়। তদনুযায়ী ৩১ ডিসেম্বর ১৯৮৯ তারিখ পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণসমূহের প্রাথমিক শ্রেণিবিন্যাসকরণ ও এইগুলি থেকে সঞ্চয় সংরক্ষণ-এর কাজ ৩১ আগস্ট ১৯৯০-এর মধ্যে সম্পন্ন হয়।

৩১ ডিসেম্বর ১৯৯০ তারিখের বকেয়া ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের স্থিতির ভিত্তিতে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯১ তারিখের মধ্যে শ্রেণিবিন্যাসিত ঋণের জন্য প্রয়োজনীয় সঞ্চয় এবং স্থগিত সুদের হিসাবকরণ সম্পন্ন হয়। পর্যায়ক্রমে শ্রেণিবিন্যাসকরণ, সঞ্চয়ের প্রাক্কলন এবং অনাদায়ী ঋণসমূহের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কাজ প্রতি বৎসরের ৩১ ডিসেম্বর তারিখের স্থিতির ভিত্তিতে পরবর্তী ৩ মাসের মধ্যে সম্পন্ন করার নিয়ম অব্যাহত থাকে। ব্যাংকগুলির ওপর তাদের নিজ নিজ ঋণের শ্রেণিবিন্যাসকরণের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয় এবং একজন ঋণগ্রহীতা যখনই তার গৃহীত ঋণ পরিশোধে অক্ষম বলে প্রতীয়মান হয়, তখনই ব্যাংক ওই ঋণকে নির্ধারিত নিয়মানুযায়ী শ্রেণিবিন্যস্ত করে। প্রদত্ত ঋণের মানের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলি নিজেরাই শর্ত নির্ধারণ করে শ্রেণিবিন্যাস করার নিয়ম প্রণয়ন করে। অতীতে ব্যাংকগুলি দ্বারা প্রদত্ত ঋণ ৩ শ্রেণিতে বিভক্ত করা হতো: ১. নিম্নমানের যেসব ঋণ বা অগ্রিম বা তার অংশ বা সুদ এক বছর বা ততোধিক কিন্তু ৩ বৎসরের কম সময় পর্যন্ত অনাদায়ী ও মেয়াদোত্তীর্ণ; ২. সন্দেহজনক যেসব ঋণ বা অগ্রিম বা তার অংশ বা সুদ ৩ বছর বা ততোধিক কিন্তু ৫ বছরের অনধিককাল অনাদায়ি ও মেয়াদোত্তীর্ণ এবং যা আদায়ের জন্য আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে; এবং ৩. খারাপ/মন্দ যেসব ঋণ বা অগ্রিম বা তার অংশ বা সুদ ৫ বছর বা ততোধিককাল অনাদায়ী রয়েছে এবং সেগুলির জন্য আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও আদালত থেকে কোনো সিদ্ধান্ত বা রায় পাওয়া যায় নি।

নির্ধারিত তারিখে একটি ঋণ/অগ্রিম স্থিতি থেকে তার ওপর উপচিত সুদের যে অংশ ‘স্থগিত সুদ’ হিসেবে নেওয়া হয়েছে তা বাদ দিয়ে ‘নিম্নমান’ শ্রেণিভুক্ত ঋণের জন্য সঞ্চয় প্রয়োজনীয়তা নির্ণয় করা হতো। নির্ধারিত তারিখে কোনো ঋণ/অগ্রিম হিসাবের বকেয়া স্থিতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত যেকোন পরিমাণ সুদ বা সুদের কোনো অংশ ‘সুদ স্থগিত হিসাব’-এ সমন্বয় করা হয়ে থাকলে তা বাদ দিয়ে সন্দেহজনক এবং ক্ষতি শ্রেণিবিন্যাসকৃত ঋণের জন্য প্রয়োজনীয় সঞ্চয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করা হতো। নিম্নমান, সন্দেহজনক এবং মন্দ শ্রেণির ঋণের জন্য যথাক্রমে ১০%, ৫০% এবং ১০০% হারে সঞ্চয় সংরক্ষণ করার নিয়ম ছিল। এ ছাড়া ব্যাংকগুলির জন্য অশ্রেণীবিন্যাসকৃত ঋণের ওপর ১% হারে সাধারণ সঞ্চয় সংরক্ষণ করা বাধ্যতামূলক ছিল।

ঋণ শ্রেণিবিন্যাসকরণ প্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করার লক্ষ্যে  বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি সংশোধিত নীতিমালা চালু করে। পাঁচটি বিভিন্ন পর্যায়ে ডিসেম্বর, ১৯৯৮-এর মধ্যে নতুন শ্রেণিকরণ পদ্ধতির বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়। নতুন পদ্ধতিতে শ্রেণিকরণের জন্য ঋণের মেয়াদকাল পূর্বের তূলনায় বহুল মাত্রায় কমানো হয় এবং শ্রেণিকরণের স্তর বাড়ানো হয়। ঋণ শ্রেণিকরণের প্রক্রিয়া সহজ করার উদ্দেশ্যে ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্যাংকগুলিকে নতুন দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। অপরদিকে নতুন পদ্ধতিতে প্রদত্ত ঋণকে ৪টি বিভিন্ন নামে চিহ্নিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশ জারি করে। নির্দেশানুযায়ী বিভিন্ন প্রকার ঋণকে চলমান ঋণ, তলবি ঋণ, মেয়াদি ঋণ এবং স্বল্পমেয়াদি কৃষি ও ক্ষুদ্র ঋণ নামে অভিহিত করা হতে থাকে। সংশোধিত পদ্ধতিতে শ্রেণিবিন্যাসকরণ এবং সঞ্চয় নির্ণয়ের জন্যও নতুন নিয়ম চালু করা হয়। তদনুযায়ী, ক. ৩ মাস বা ততোধিক কিন্তু ৬ মাসের কম সময় পর্যন্ত কোনো ঋণ অনাদায়ী বা মেয়াদোত্তীর্ণ থাকলে ওই ঋণকে ‘নিম্নমান’, খ. ৬ মাস বা ততোধিক কিন্তু অনধিক ১ বছর সময় ধরে অনাদায়ী হলে ‘সন্দেহজনক’ এবং গ. এক বৎসরের অধিক সময় মেয়াদোত্তীর্ণ হলে ওই ঋণকে মন্দ বা লোকসানি শ্রেণির বিবেচনা করা হয়। একই সঙ্গে উল্লিখিত নিম্নমান, সন্দেহজনক এবং মন্দ শ্রেণিভুক্ত ঋণের জন্য যথাক্রমে ২০%, ৫০% এবং ১০০% হারে সঞ্চয় সংরক্ষণের নতুন নিয়মও চালু করা হয়। এ ছাড়া ব্যাংকগুলিকে প্রথম পর্যায়ে বাৎসরিক ভিত্তিতে এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে যথাক্রমে ষান্মাসিক ও ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ঋণসমূহ শ্রেণিবিন্যাসকরণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আরও নির্দেশ দেওয়া হয়, ১৯৯৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে শ্রেণিবিন্যাস করার জন্য নতুন, নবায়নকৃত ও পুনঃতফশিলীকৃত ঋণকে নতুন ঋণ হিসেবে অভিহিত করা হবে এবং ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে সঞ্চয় সংরক্ষণ করতে হবে।

ঋণ শ্রেণিবিন্যাসকরণের নতুন নীতিমালা বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় বিদ্যমান খেলাপি ঋণের মাত্রা এবং এ সংক্রান্ত মারাত্মক সমস্যার স্বরূপ উদঘাটিত হয়। দেখা যায়, ব্যাংকগুলির ঋণ-পত্রকোষ এবং এর গুণগত মান খুবই নিম্নপর্যায়ে অবস্থান করছে। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলি খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে এনে সম্পদের মান বৃদ্ধি ও আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে তৎপর হয়ে ওঠে। নতুন শ্রেণিবিন্যাসকরণ পদ্ধতি অনুযায়ী ব্যাংকগুলিকে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের ওপর অনাদায়ী উপচিত সুদ হিসাবের মাধ্যমে কৃত্রিম মুনাফা প্রদর্শন থেকে বিরত রাখা হয়। নতুন ঋণ শ্রেণিবিন্যাসকরণ পদ্ধতি ব্যাংকগুলির খেলাপি ঋণ আদায়ের এবং খারাপ ঋণ প্রদানে সতর্ক করে তাদেরকে নিশ্চিত বিলুপ্তির কবল থেকে রক্ষা করতে শুরু করেছে।

ঋণ শ্রেণিবিন্যাসকরণ ও প্রভিশনিং-এর মানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীতকরণের প্রয়াসে ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে গৃহীত দুরদর্শিতামূলক নিয়মাচারের সময়ে সময়ে পরিবর্তন সাধন করে। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ২০০৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘বিশেষ চিহ্নিত হিসাব’ ব্যবস্থার প্রবর্তন করে যেখানে ৯০ দিন বা তার অধিক সময়ের জন্য অনাদায়ী ঋণ প্রদশিত হবে এবং এর ওপর আরোপিত সুদে ‘সাসপেন্স’ সুদ আয় হিসেবে না ধরে ‘সাসপেন্স সুদ হিসেবে’ জমা করতে হবে। তবে বিশেষভাবে চিহ্নিত এ সব হিসাবের ঋণকে খেলাপীঋণ হিসেবে গণ্য করা হবে না, বরং ঋণের দুর্বলতা নির্দেশপূর্বক পূর্ব সতর্কতামূলক সংকেত হিসেবে তা গণ্য হবে। এ সব ঋণের জন্য ব্যাংকসমূহকে সাধারণভাবে শতকরা ৫ ভাগ হারে অতিরিক্ত স্থিতি রাখতে হবে। ফলে পূর্বে চালুকৃত ৪ ধরনের শ্রেণি বিন্যাসিত ঋণের বিপরীতে তা ৫ ধরনের শ্রেণি বিন্যাসে উন্নীত হয়। ২০০৭ সাল হতে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকসমূহের স্থিতিপত্র বহির্ভূূত অবস্থানের শতকরা ১ ভাগ অতিরিক্ত রাখার বিধানও চালু করে।

ঋণ শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ ব্যাংকসমূহের সম্পদের গুণগতমানের উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন করে। ব্যাংকসমূহের প্রকাশিত প্রতিবেদন হতে দেখা যায় যে, মোট ঋণে অকার্যকর ঋণের অনুপাত ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর শেষে শতকরা ৪১.১ ভাগ থেকে ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়ে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর শেষে শতকরা ১০.৮ ভাগে নেমে এসেছে। যদিও এটাকে একটা উৎসাহব্যঞ্জক গতিধারা হিসেবে গণ্য করা যায় তথাপি তা এখনো বাংলাদেশের অনেক নিকট প্রতিবেশী দেশের নিরিখে এখনও অনেক বেশি। সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকসমূহ ও উন্নয়ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (DFIS) উচ্চ মাত্রার অকার্যকর ঋণ এ জন্য দায়ী। মূলত ৭০ এবং ৮০-এর দশকে এ সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কোনরূপ আর্থিক বিবেচনা ছাড়া চাপে পড়ে যে সব ঋণ বিতরণ করে তা তাদের মোট ঋণ স্থিতিতে অন্তর্ভুক্ত থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অতীতে বিতরণকৃত এসব ঋণ দুর্বল মূল্যায়ন এবং পরবর্তীকলে তা পরিবেক্ষণ ও পরিদর্শনের অপর্যাপ্ততার কারণে নিম্নমানের সম্পদ হিসেবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বিবরণীতে অন্তর্ভুক্ত হয় যা অদ্যবধি পোর্টফলিও-এর একটা বিরাট অংশ হিসেবে বিদ্যমান। ওই সমস্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ জমাকৃত মন্দ ঋণের বিপরীতে নিম্নমানের জামানত থাকা সত্ত্বেও এসব ঋণ অবলোকনে অনাগ্রহী ছিল। এ সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য গৃহীত পদক্ষেপসমূহ যথা ঋণ আদায় প্রক্রিয়াকে শক্তিশালীকরণে কাঠামোগত পুনর্গঠন, ঋণ আদায়ের পদক্ষেপ জোরদারকরণ এবং মন্দ ঋণের অবলোকন সংক্রান্ত গৃহীত ব্যবস্থাদি অকার্যকর ঋণ আদায় পরিস্থিতিতে সাম্প্রতিক বছরসমূহে উন্নতির লক্ষণ দৃশ্যমান।

[আব্দুস সামাদ সরকার এবং সৈয়দ আহমেদ খান]