ইমাম, আখতার

ইমাম, আখতার (১৯১৭-২০০৯)  শিক্ষাবিদ, লেখক, সমাজকর্মী, নারী জাগরণের অন্যতম কর্মী। তাঁর জন্ম ১৯১৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকার নারিন্দায় মাতামহের বাড়িতে। তিনি ইডেন স্কুল এ্যান্ড ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ফর গার্লস থেকে ১৯৩৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৩৫ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেথুন কলেজ থেকে ১৯৩৭ সালে দর্শন শাস্ত্রে অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রীদের মধ্যে অনার্সে প্রথম স্থান অধিকার করায় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গঙ্গামণি দেবী স্বর্ণ পদকে’ ভূষিত হন।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৬ সালে দর্শন শাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। অবিভক্ত বাংলায় ‘বেঙ্গল মুসলিম এড্যুকেশন ফান্ডের সরকারি ওভারসীজ বৃত্তি’ পেয়ে ১৯৫২ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে দর্শনে পুনরায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৬৩-৬৫ দুবছর যুক্তরাজ্যের নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন শাস্ত্রে উচ্চতর গবেষণা করেন। মার্চ ১৯৪৩ থেকে মার্চ ১৯৫৬ পর্যন্ত তিনি ইডেন স্কুল ও কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৫৬ সালের মার্চ মাসে পদোন্নতি পেয়ে ঢাকা কলেজের প্রথম মহিলা প্রফেসর এবং প্রথম মহিলা বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করেন।

১৯৫৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী হল ‘উইমেন হল’ (পরবর্তীতে ‘রোকেয়া হল’)-এর প্রথম ও স্থায়ী প্রভোস্ট পদে যোগদান করেন। ১৯৫৩ সাল থেকে দর্শন বিভাগে কয়েক বছর খন্ডকালীন ও পরে নিয়মিত শিক্ষকতা করেন এবং ১৯৬৮-৬৯ এ বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইউনিসেফ, ইউনেস্কো এবং দেশ-বিদেশের সরকার ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালে ‘পাকিস্তান ফিলসফিক্যাল কংগ্রেস’-এর পঞ্চদশ সম্মেলনে জেনারেল প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এই কংগ্রেসের এক দফা যুগপৎ ট্রেজারার ও সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ‘বাংলাদেশ দর্শন সমিতির’ এবং ‘বাংলাদেশ দর্শন কংগ্রেসের’ সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তিনি ‘বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ’-এ তিনবছর সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রবীণ মহিলা সংগঠন ‘হেমন্তিকা’র আজীবন সভানেত্রী ছিলেন।

তিনখন্ড আত্মজীবনীসহ বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ১৮টি। এর কয়েকটি হলো রোকেয়া হলে বিশ বছর (১৯৮৬), ইডেন থেকে বেথুন (১৯৯০), আমার জীবনকথা (১৯৯৩), আমার জীবনকথা বিলেতের দিনগুলো(১৯৯৭), আমার জীবনকথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (২০০২), David Hume on the Nature of the Self  (1976)|

আখতার ইমামের লেখা হিউম্যার, সূক্ষ্মরসবোধ ও বাস্তবজীবনবোধেমূর্ত। সমাজের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিচিত্র ধরনের মানুষ সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, নারীর প্রতি সমাজের বৈষম্যমূলক আচরণ ও প্রচলিত কুসংস্কার তাঁর বিভিন্ন রচনায় অত্যন্ত জোরালোভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার জীবনকথা’য় বিংশশতাব্দীর প্রথমদিকে ঢাকাবাসীর আর্থসামাজিক অবস্থান, সমাজব্যবস্থা, শিক্ষার মান ও তাঁর সংগ্রামমূখর জীবনের বহু বৈচিত্র্যময় ঘটনা অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে পরিবেশ করা হয়েছে। তাঁর রচনায় জেন্ডার বৈষম্য বিষয়টি পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতি শাণিত বিদ্রূপ হেনেছে। পারিবারিক যেসব ঘটনা নারীত্বের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করেছে তা অত্যান্ত সুস্পষ্ট, নির্মোহ ও সত্যনিষ্ঠভাবে তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে বর্ণনা করেছেন।

১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অধ্যাপক আখতার ইমামকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৫ বর্ষপূর্তিতে ঢাকা ইউনিভার্সিটি এলামনাই এ্যাসোসিয়েশন সম্মাননা স্মারক প্রদান করে। ১৯৯৮ সালে ভারতের স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ‘শিক্ষা দিবসে’ কোলকাতার ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ এন্ড রিসার্চ কর্তৃক সংগ্রামী ও প্রতিষ্ঠিত লেখক হিসেবে তাঁকে বিশেষ সংবর্ধনাপত্র ও স্মারক প্রদান করে। আখতার ইমাম শিক্ষা, নারী অধিকার ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গৌরবময় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ২০০২ সালের ‘বেগম রোকেয়া পদক’-এ ভূষিত হন। আখতার ইমামের মৃত্যু ঢাকায় ২২ জুন ২০০৯। [রওশন আরা ফিরোজ]