আহমেদ, কমরেড মুজাফ্ফর

কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদ

আহমেদ, কমরেড মুজাফ্ফর  (১৮৮৯-১৯৭৩)  বিপ্লবী, ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথিকৃৎ। ১৮৮৯ সালের ৫ আগস্ট নোয়াখালী জেলার সন্দ্বীপে মুজাফ্ফর আহমেদ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মনসুর আলী ছিলেন একজন আইনজীবী। সন্দ্বীপে কারগীল হাইস্কুলে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি মাদ্রাসায় এবং আরও পরে নোয়াখালী জেলা স্কুলে পড়াশোনা করেন।

প্রথমে হুগলি কলেজ এবং পরে বঙ্গবাসী কলেজে কলা শাখায় ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে মুজাফ্ফর আহমেদ রাইটার্স বিল্ডিং-এর ছাপাখানার চাকরিতে যোগ দেন। এরপর তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদক হিসেবে কাজ করেন। একই সময়ে তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সহ-সম্পাদক ছিলেন। ১৯১৬ সাল থেকে তিনি রাজনৈতিক মিটিং-মিছিলে যোগ দিতে শুরু করেন এবং ১৯২০ সালের শুরুতে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯২০ সালে মুজাফ্ফর আহমেদ বঙ্গীয় প্রাদেশিক খিলাফত কমিটির সদস্য মনোনীত হন।  ১৯২০ সালের ১২ জুলাই মুজাফ্ফর আহমেদ নবযুগের যুগ্মসম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। অপর সম্পাদক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। মুজাফ্ফর আহমেদ এই পত্রিকায় কর্মজীবী মানুষের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ফিচার লেখেন। ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি নবযুগ থেকে পদত্যাগ করেন।

১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর তাসখন্দে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রথম বারের মতো আত্মপ্রকাশ করে। কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদ আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিদেশ থেকে এ সংক্রান্ত কাগজপত্র ও জার্নাল সংগ্রহ করতে শুরু করেন। ১৯২২ সালের ১৫ মে The Vanguard of the Indian Independence শিরোনামে পার্টির প্রথম মুখপত্র প্রকাশিত হয়। ১৯২২ সালের শেষের দিকে মুজাফ্ফর আহমেদ কমরেড আব্দুল হালিমের সঙ্গে পরিচিত হন এবং তাঁরা যৌথভাবে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

ইতোমধ্যে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট পার্টির ব্রাঞ্চ হিসেবে তার কর্মতৎপরতা শুরু করেছিল। মুজাফ্ফর আহমেদ কর্মজীবী শ্রেণি আন্দোলনে যোগ দিতে শুরু করেন এবং ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। ১৯২৩ সালের ১৭ মে তিনি গ্রেফতার হন। এর অব্যবহিত পরেই কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে ১৯২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁকে ৪ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়। অবশ্য কিছুকাল পর তিনি যক্ষ্মা রোগে অসুস্থতার কারণে মুক্তি পান। ১৯২৯ সালের ২০ মার্চ মুজাফ্ফর আহমেদ কলকাতাতে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়ে পুনরায় গ্রেফতার হন। তাঁকে সব মিলিয়ে প্রায় ২০ বছর ব্রিটিশ ও কংগ্রেস সরকারের জেলে অতিবাহিত করতে হয়। জেলে থাকাকালীন তিনি রাজনৈতিক বন্দিদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার দাবিতে দু’দুবার   অনশন ধর্মঘট করেন।

মুজাফ্ফর আহমেদ আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে কর্মপরিচালনার বিভিন্ন পদ্ধতি রপ্ত করেন এবং অন্যান্য নেতাদের এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেন। ৮ বছরের মধ্যে তিনি প্রায় ৫ বার পার্টি সংগঠন ও আন্দোলনের জন্য আত্মগোপন করেন। ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় প্রতিনিধি সম্মেলনে তিনি জেলে থাকা অবস্থাতেই কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালে পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস ব্যতীত পার্টির সব কংগ্রেসেই কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি নির্বাচিত হন।

১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি অবিভক্ত বাংলার ২৮টি জেলাতেই ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার সদস্য এতে যোগ দিতে শুরু করে। ট্রেড ইউনিয়ন ও কিষাণ সভা গড়ে উঠতে থাকে সর্বত্র। ১৯৫০-এর দশকের পুরোটাই ব্যয় হয় পার্টি পুনর্গঠনের কাজে। বিধান সভার ভিতরে ও বাইরে পার্টি একটি জাতীয় রাজনৈতিক দলে পরিণত হতে শুরু করে এবং কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদ ছিলেন এই সমস্ত কিছুরই কেন্দ্রবিন্দুতে। ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত সময়কালে তিনি ছিলেন পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদক।

মুজাফ্ফর  আহমেদের  কিছু  কিছু  চারিত্রিক  বৈশিষ্ট্য  সবারই  দৃষ্টি  আকর্ষণ করে। কর্মজীবী শ্রেণির  আন্তর্জাতিকতার প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ, গণতন্ত্রের প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়, নারীর সম-অধিকারের প্রতি তীব্র আগ্রহ সব মিলিয়ে তাঁকে একজন মহান বিপ্লবীতে পরিণত করে।

পার্টি ব্যবস্থাপনা, গণআন্দোলন, নির্বাচনের টানাপোড়ন ইত্যাদি সম্বন্ধে ছিল তাঁর পরিষ্কার ধারণা। তিনি মার্কস ও লেনিনের রচনাবলী ও কর্মজীবন সম্পর্কে বিশদভাবে জানতেন এবং দেশে প্রচলিত আইন ও নিয়ম-কানুন সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন। তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় খুঁটিনাটি সমস্ত নিয়মই অনুসরণ করতেন এবং ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সব নির্বাচনেই সক্রিয় নেতৃত্ব প্রদান করেন। তিনি ছিলেন কর্মজীবী শ্রেণির আর্ন্তজাতিকতাবাদের অনুসারী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে তিনি গর্ব করতেন।

তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মানসিক উদারতার জন্য সংবাদপত্র ও বাকস্বাধীনতা এবং নব ধ্যান-ধারণায় উৎসাহ প্রদানে আইডিয়ার আদান-প্রদান অত্যন্ত জরুরি। তিনি প্রেস, সংবাদপত্র ও গ্রন্থের বিষয়ে ছিলেন অত্যন্ত সাবধানী এবং এতে ছিল তাঁর অগাধ ভালবাসা। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি এবং গণশক্তি প্রেস তাঁরই সৃষ্টি। তাঁর বিভিন্ন বিষয়ের উপর লেখা অসংখ্য প্রবন্ধ বিভিন্ন জার্নাল ও ম্যাগাজিনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কৃষকদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তাঁর লেখা এবং তাঁর গ্রন্থ 'Communist Party of India: Years of Formation 1921-1933' এবং 'Myself and the Communist Party of India' সমসাময়িক রাজনীতি সম্বন্ধে আলোকপাত করে।

১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদ এর মৃত্যু হয়। তাঁর ৬০ বছরের রাজনৈতিক কর্মজীবনে ৫২ বছরই তিনি পার্টির একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে কাজ করে গেছেন।  [রঞ্জিৎ রায়]