আহমদ, বিচারপতি শাহাবুদ্দিন

বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ

আহমদ, বিচারপতি শাহাবুদ্দিন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার পেমল গ্রামে ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা তালুকদার রেসাত আহমদ ভূঁইয়া ছিলেন একজন খ্যাতনামা সমাজসেবক ও জনহিতৈষী ব্যক্তি। শাহাবুদ্দিন আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫১ সালে অর্থনীতিতে (সম্মান) স্নাতক এবং ১৯৫২ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। তিনি লাহোর সিভিল সার্ভিস একাডেমী থেকে সাফল্যের সঙ্গে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন বিষয়ে একটি বিশেষ কোর্সে অংশগ্রহণ করেন।

ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে এবং পরে গোপালগঞ্জ ও নাটোরের মহকুমা প্রশাসক পদে কিছুকাল চাকরির পর শাহাবুদ্দিন আহমদ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৬০ সালের জুন মাসে তাঁকে বিচার বিভাগে বদলি করা হয় এবং প্রশাসনের নির্বাহী বিভাগে তাঁর চাকরির সমাপ্তি ঘটে। তিনি ঢাকা ও বরিশালে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি তাঁকে বাংলাদেশ হাইকোর্টের বিচারক পদে উন্নীত করা হয়। তিনি প্রেষণে নিযুক্ত হয়ে শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন (১৯৭৩-৭৪)। এরপর তিনি বিচারপতি হিসেবে হাইকোর্ট বিভাগে প্রত্যাবর্তন করেন।

১৯৮০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি শাহাবুদ্দিন আহমদকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগের বিচারক নিয়োগ করা হয়। বিচারপতি হিসেবে তাঁর প্রদত্ত বহুসংখ্যক রায় ঢাকা ল’ রিপোর্টস্, বাংলাদেশ লিগ্যাল ডেসিশন্স এবং বাংলাদেশ কেইস রিপোর্টস্-এ প্রকাশিত হয়। চাকরি সংক্রান্ত বিষয়, নির্বাচনী বিরোধ এবং শ্রমিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক বিষয়ে তাঁর প্রদত্ত কিছু রায় উচ্ছ্বসিত প্রশংসা লাভ করে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৮ম সংশোধনীর উপর তাঁর প্রদত্ত রায় দেশের শাসনতান্ত্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে এক অনন্য ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত। এখানে তিনি অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে নিজস্ব ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করা, গোষ্ঠী শাসন প্রতিষ্ঠা, মৌলিক মানবাধিকার খর্ব করা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, জনগণের সার্বভৌমত্বের বিরোধিতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অস্বীকৃতি এবং আইনের শাসনের পরিবর্তে আদেশ জারির মাধ্যমে সংবিধান রহিত করার প্রবণতার জন্য তৃতীয় বিশ্বের একনায়ক শাসকদের সমালোচনা করেছেন। বিচার বিভাগে নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও ছুটির ক্ষেত্রে হাইকোর্টের চিরাচরিত ক্ষমতা খর্ব  করা এবং রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক নিম্ন আদালতসমূহ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারেও তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভরত ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলি বর্ষণের ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি শাহাবুদ্দিন। ওই ঘটনায় কয়েকজন ছাত্র নিহত এবং বহু ছাত্র আহত হয়। কিন্তু ব্যাপক তদন্ত চালিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করা হলেও তৎকালীন সরকার কর্তৃক এই তদন্ত প্রতিবেদন কখনোই সাধারণ্যে প্রকাশ করা হয় নি। তিনি ১৯৮৪ সালে গঠিত জাতীয় বেতন কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর রিপোর্টের ভিত্তিতে উচ্চতর হারে বেতন স্কেল নির্ধারণ করা হয়। ১৯৭৮ সালের আগস্ট থেকে ১৯৮২ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত আপীল আদালতের বিচারপতিদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি যোগদান করেন।

১৯৯০ সালের ১৪ জানুয়ারি শাহাবুদ্দিন আহমদকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। এ সময় স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন এবং রাষ্ট্রপতি এইচ.এম এরশাদ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে পরিচালিত গণআন্দোলনের ফলে দেশে এক শান্তিপূর্ণ বিপ্লব ঘটে। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করেন এবং বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়। ওই দিনই রাষ্ট্রপতি এরশাদ পদত্যাগ করে নবনিযুক্ত উপরাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি সরকার প্রধানের দায়িত্ব লাভ করেন। নিরপেক্ষ অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে তিনি ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করেন। সরকার-প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ বেশ কিছুসংখ্যক আইন সংশোধন করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। এরপর নতুন রাষ্ট্রপতির নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণের পর শাহাবুদ্দিন আহমদ ১৯৯১ সালের ১০ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে সুপ্রিম কোর্টে ফিরে যান। ১৯৯৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৯৬ সালের ২৩ জুলাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় অতি সীমিত ক্ষমতার অধিকারী হলেও রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর পাঁচ বছরের শাসনকালে রাষ্ট্রীয় সকল বিষয়ে তাঁর নিরপেক্ষ ভূমিকা এবং বিবেকবুদ্ধির জন্য তিনি দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের আপামর জনগণের ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও প্রশংসা অর্জন করেন। ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর তিনি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।  [কাজী এবাদুল হক এবং হেলাল উদ্দিন আহমদ]