আহমদ, নওয়াজেশ

আহমদ, নওয়াজেশ (১৯৩৫-২০০৯)  উদ্ভিদ জিনতত্ত্ব বিজ্ঞানী, আলোকচিত্রী। মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানার পারিল নওয়াধা গ্রামে এক জমিদার পরিবারে ১৯৩৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম। পিতা খান বাহাদুর নাজিবউদ্দিন আহমদ। নওয়াজেশ আহমদ ১৯৫০ সালে মানিকগঞ্জ ভিক্টোরিয়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৫২ সালে আই.এস.সি এবং ১৯৫৪ সালে ঢাকার ইস্ট বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট (বর্তমান শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে বি.এজি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং উইস্কনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্লান্ট জেনেটিক্স (উদ্ভিদ জিনতত্ত্ব) বিষয়ে গবেষণা করে ১৯৬০ সালে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আমেরিকান ফাউন্ডেশন ফর বায়োগ্রাফী রিসার্চ থেকে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপ সম্পন্ন করে তিনি ১৯৬০ সালে দেশে ফিরে আসেন এবং ডানকান ব্রাদার্স টি-এস্টেটে গবেষণা উপদেষ্টা পদে যোগ দেন। এসময় তিনি দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের চা বাগানে চায়ের রকমফের নিয়ে দীর্ঘকাল গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। অচিরেই সরকার তাঁকে পাকিস্তান টি বোর্ডের সদস্য-সচিব নিয়োগ করে।

নওয়াজেশ আহমদ

১৯৭৯ সাল থেকে নওয়াজেশ আহমদ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কৃষি উপদেষ্টা হিসেবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দীর্ঘকাল পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেক্সনোলজিতে ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি ছিলেন। নওয়াজেশ আহমদ ছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী। তাঁর আলোকচিত্রের প্রধান প্রতিপাদ্য ছিল নিসর্গ, বিশেষত উদ্ভিদ। যুক্তরাষ্ট্রের উইস্কনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদ জিনতত্ত্ব বিষয়ে অধ্যয়নকালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও লাইফ টাইম ম্যাগাজিনের যৌথ উদ্যোগে ১৯৫৭-৫৮ সালে অনুষ্ঠিত পোর্ট্রেট অব অ্যামেরিকা এক্সিবিশনে অংশগ্রহণ করেন এবং তখনই তিনি একজন আলোকচিত্রী হিসেবে বিদেশে স্বীকৃতি লাভ করেন।

যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রদর্শনীতে তাঁর নির্মিত আলোকচিত্র প্রদর্শিত হয়েছে, মুদ্রিত হয়েছে সানডে টাইমস, গার্ডিয়ান, ফোকাস, ব্যাংকক পোস্ট, হেমিস্ফিয়ার, ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া, ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ-এর মতো বিশ্ববিশ্রুত সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে। নওয়াজেশ আহমদ মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশিদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে আলোকচিত্র ব্যবহার করেন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি পাকিস্তান টি বোর্ডের চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে লন্ডনে চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে প্রবাসী বাঙালিদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং সেখানে আলোকচিত্র ও স্লাইড শো প্রদর্শনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির কর্মসূচী গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে আসেন।

১৯৭৮ সালে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে নওয়াজেশ আহমদ তাঁর প্রদর্শিত আলোকচিত্রের সৌকর্য ও শিল্পনৈপুণ্যের জন্য ‘শিল্পকলা একাডেমী অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। ১৯৯৬ সালে শিল্পকলা একাডেমীতে বাস্তবের অণ্বেষা শিরোনাম ও ব্যানারে অনুষ্ঠিত হয় তাঁর আলোকচিত্রের এক প্রদর্শনী। ২০০৫ সালের জুন মাসে সমন্বয়ের সন্ধানে শিরোনামে তাঁর আলোকচিত্রের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় বেঙ্গল গ্যালারিতে।

নওয়াজেশ আহমদই বস্ত্তত বাংলাদেশে প্রথম একান্তভাবে নিসর্গ বিষয়ক সৃজনশীল আলোকচিত্র নির্মাণের ধারার সূচনা করেন। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয় Bangladesh নামে তাঁর প্রথম রঙীন ফটো-অ্যালবাম। বাংলাদেশে মানুষের জীবনযাত্রা ও প্রাকৃতিক পরিবেশের আকর্ষণীয় চিত্র সম্বলিত এ অ্যালবামটিতে যুগপৎ ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান ভাষায় বিষয় বর্ণনা দেয়া হয়েছে। ব্রিটিশ জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি এ অ্যালবামকে ‘বুক অব দ্য ইয়ার’ বিশেষণে ভূষিত করে। নওয়াজেশ আহমদের অপর উল্লেখযোগ্য ফটো-অ্যালবাম হলো: Potrait of Bangladesh (১৯৮২), Burma (১৯৯০), বাস্তবের অণ্বেষা (১৯৯৬), Quest for Reality (১৯৯৭), Wild Flowers of Bangladesh (১৯৯৮), Gautam (বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জীবনভিত্তিক), বাংলার বনফুল (২০০১), ছিন্নপত্র (২০০২), ধানসিড়ি নদীটির পাশে (২০০৪)। তিনি লাওস ও থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জীবনাচরণ ভিত্তিক এক ঘণ্টার একটি স্লাইড সাউন্ড প্রোগ্রাম তৈরি করেন। তিনি বৌদ্ধ চৈত্য ও ভাস্কর্য সমন্বয়ে একটি চলচ্চিত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিন্নপত্র এবং জীবনানন্দ দাসের ধানসিড়ি নদীটির পাশে গ্রন্থভিত্তিক ভিডিও স্লাইড তৈরি করেন। এগুলো প্রদর্শিত হয় কোলকাতা, শান্তি নিকেতন ও ঢাকায়।

লেখক হিসেবে নওয়াজেশ আহমদ কৃষি বিষয়ে অসামান্য অবদান রেখেছেন। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ Development of Agriculture of Bangladesh কৃষি বিষয়ে তাঁর ব্যাপক গবেষণার ফসল এবং বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি দিগনির্দেশক গ্রন্থ। এ গ্রন্থ এবং কৃষি বিষয়ে তাঁর ব্যাপক গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৮ সালে তাঁকে প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল প্রদান করা হয়। তাঁর অপর কয়েকটি গ্রন্থ বন-বনানী (১৯৯১), মহাবনস্পতির পদাবলী, আহত কোকিল। তাঁর কৃষি বিষয়ক গবেষণা নিবন্ধ ছাড়াও পত্রপত্রিকায় প্রকৃতি, গাছগাছালী ও ফুল ফলসহ বিভিন্ন বিষয়ে বহুসংখ্যক সচিত্র নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নওয়াজেশ আহমদ ২০০৩ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়া’য় কনসাল্টিং এডিটর ছিলেন।

আজীবন অকৃতদার নওয়াজেশ আহমদ ছিলেন একাধারে বিজ্ঞানী ও শিল্পী। নিসর্গের প্রতি গভীর আত্মিক সম্পর্কের এই সৃজনশীল আলোকচিত্রী প্রকৃতিকে তুলে এনেছেন বিচিত্র রঙীন অবয়বে ও সূক্ষ্ম দ্যোতনায়, আর এ কাজটি তিনি করেছেন একজন আলোকচিত্রীর চেয়ে বরং এক নিপুণ চিত্রকরের ন্যায়।

২০০৯ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়। [মুয়ায্‌যম হুসায়ন খান]