আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে

আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে  ব্রিটিশ ভারতের পূর্বাঞ্চল, বিশেষত আসাম ও পূর্ববাংলার উন্নয়নের উদ্দেশ্যে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে স্থাপনের ধারণার উদ্ভব হয়। এক আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, ওই সময় পর্যন্ত এ উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে ২৩,৬৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথের বিস্তার ঘটেছিল। তবে পূর্বাঞ্চলে উল্লেখযোগ্য চালু রেলপথ ছিল  ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে, যা বিস্তৃত ছিল কলকাতা থেকে  গড়াই ও গঙ্গা নদীর সঙ্গমস্থলের নিকটস্থ কুষ্টিয়া পর্যন্ত। ১৮৭০ সালে গঙ্গা নদী ও  ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গমস্থল গোয়ালন্দ পর্যন্ত এ পথকে বাড়ানো হয়েছিল এবং আরও পরে, তবে ১৯০২-এর পূর্বে নয়, আসামের ধুবড়ি পর্যন্ত তা প্রসারিত হয়। গঙ্গা নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদে যারা দেশি  নৌকা ও সদ্য চালু করা বাষ্পীয় নৌযানে কলকাতা ও উত্তরবঙ্গের মধ্যে গোয়ালন্দের ভেতর দিয়ে চলাচল করত, গোয়ালন্দ পর্যন্ত বিস্তৃত এ রেলপথ তাদের চাহিদা মেটাতে পারবে বলে আশা করা হয়েছিল।

তবে বাস্তবে দেখা গেল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই  সুন্দরবন হয়ে গঙ্গার মূলপ্রবাহ ধরে বিপদসংকুল ও ব্যয়বহুল পুরানো ঘুরপথেই যাতায়াত চলছে। এ সময়টাতে বিদেশে অন্যান্য জিনিসের মধ্যে পূর্ববাংলার আসাম ও সিলেট জেলার  চা এবং কয়েকটি জেলার বিশেষত ঢাকা ও ময়সনসিংহ এর প্রধান কৃষিপণ্য  পাটএর জন্য বিদেশে বাজার সৃষ্টি হয়। আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে  চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সহজে এসব পণ্যের বিভিন্ন বিদেশি বাজারে প্রেরণ নিশ্চিত করত। উনিশ শতকে রেলপথ স্থাপনের আগেও ঢাকা সড়কপথে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে সংযুক্ত ছিল এবং দু জায়গার মাঝে নিয়মিত যাতায়াত চালু ছিল। এ যোগাযোগ উন্নত করাও ছিল আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের লক্ষ্য। এর ফলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নতির পথ সুগম হয়। ১৮৯২ সালে আসাম-বেঙ্গল রেল কোম্পানি গঠিত হয়। নির্মাণ ব্যাপারে রেলপথটিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়: প্রথমটি শিলচর ও  লাকসামএ শাখাসহ চট্টগ্রাম-বদরপুর পথ, দ্বিতীয়টি বদরপুর থেকে লুম্বডিং, তৃতীয়টি গৌহাটি থেকে লুম্বডিং এবং আরও উত্তরে মাকুম পর্যন্ত। শাখা তিনটির প্রথমটি চট্টগ্রাম-কাছার শাখা নামে অভিহিত এবং তা ১৮৯৮ সাল নাগাদ চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। দ্বিতীয়টি পাহাড়ি শাখা নামে পরিচিত এবং তা সম্পন্ন হতে প্রায় এগারো বছর লেগে যায়। বিভিন্ন উচ্চতার পাহাড়ের উপর দিয়ে রেলপথ স্থাপন গুরুতর প্রকৌশলগত সমস্যা সৃষ্টি করে। নির্মাণ কাজের জন্য সরঞ্জাম ও শ্রমিক সরবরাহ, এবং শ্রমিকদের জন্য খাদ্য সরবরাহ এক দুরূহ ব্যাপার ছিল। এ শাখা ১৯০৪ সালে চালু হয়। এ রেলপথকে উত্তর আসামের চা উৎপাদনকারী এলাকাসমূহ এবং ভৈরব বাজারের মধ্য দিয়ে ময়মনসিংহ ও ঢাকার পাট উৎপাদনকারী এলাকাসমূহ পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়। এ রেলপথকে চাঁদপুর পর্যন্ত বাড়ানো হয় যাতে বাষ্পীয় নৌযানে যাত্রী ও পণ্য গোয়ালন্দ পর্যন্ত এসে সেখান থেকে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে দিয়ে কলকাতা বন্দর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। ১৯০৪ সাল নাগাদ আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে তার পুরো পথ জুড়ে চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে চা ও পাটের রপ্তানি বিপুলভাবে বেড়ে গিয়েছিল। চট্টগ্রাম বন্দরের বাণিজ্যের পরিমাণ ১৯০৪-এ ছিল ৩৯.২৩ মিলিয়ন রুপি, যা ১৯২৮ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ১৮৩.২৫ মিলিয়ন রুপি হয়। ১৯৪২ সালে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে ও ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের একত্রীকরণে নতুন নামের রেলপথ ‘দ্য বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম রেলওয়ে’ আত্মপ্রকাশ করে। [হেনা মুখার্জী]