আল ইসলাহ

আল ইসলাহ (১৯৩২ )  সাহিত্য পত্রিকা। বিশ শতকের তৃতীয় দশকে সিলেটের মুসলমান সমাজে এক নবজাগরণের সূচনা  হয় এবং এর মূলে খেলাফত আন্দোলনের প্রভাব সুস্পষ্ট। এ আন্দোলনের ফলে যে দেশাত্মবোধ ও ঐতিহ্যচেতনা জেগে উঠে তা সমকালীন মুসলমানদের মানসগঠনে বিশেষভাবে সহায়ক ছিল। কিন্তু সেকালের আলেমসমাজ, মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রসমাজ মাতৃভাষা বাংলার প্রতি উদাসীন ছিলেন। মাতৃভাষা চর্চায় তাদের অনাগ্রহ সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মুহম্মদ নূরুল হক (১৯০৭-১৯৮৭)-কে পীড়িত করে। সিলেটের মুসলমান সমাজকে মাতৃভাষা চর্চায় আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে তিনি হাতে লেখা ত্রৈমাসিক পত্রিকা অভিযান প্রকাশ করেন। কয়েকজন শিক্ষক ও সহপাঠীর সহযোগিতায় তিনি ১৯৩২ সালে পত্রিকাটি মুদ্রণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এসময় অভিযান নাম পরিবর্তন করে আল ইসলাহ রাখা হয়।

পত্রিকাটির লক্ষ্য ছিল নবীন-প্রবীণ লেখকগণের প্রচেষ্টায় মাতৃভাষার মাধ্যমে ইসলামি সংস্কৃতি ও তমদ্দুনের বিকাশ সাধন। ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে (নভেম্বর-ডিসেম্বর ১৯৩২) পত্রিকাটির প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। নিজস্ব ছাপাখানা এবং পর্যাপ্ত তহবিল না থাকায় পত্রিকাটির প্রকাশনা বিভিন্ন সময়ে বিঘ্নিত হয়েছে। মুহম্মদ নূরুল হক ১৯৩২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন।

প্রথম বর্ষ থেকে একাদশ বর্ষ (১৩৩৯ অগ্রহায়ণ থেকে ১৩৫৬ চৈত্র পর্যন্ত) প্রকাশের পর সাময়িকভাবে আল ইসলাহ  প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। ১৩৬৩ বঙ্গাব্দ থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ের যাত্রা শুরু হয়। ১৩৭৭ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে (মার্চ ১৯৭১) মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আল ইসলাহ প্রকাশনা আবারও স্থগিত থাকে। ১৩৮৫ বঙ্গাব্দে পত্রিকাটির তৃতীয় পর্যায়ের প্রকাশনা শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৩৯১ বঙ্গাব্দে। প্রথমে আল ইসলাহ ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানদের সমর্থন খুব বেশি লাভ করেনি। তৃতীয় বর্ষ থেকে পত্রিকাটির সাহিত্য অংশ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এ সময় পত্রিকাটির সম্পাদকীয় কলামে মুসলিম লীগের রাজনীতি সমর্থন করায় আলেমসমাজ আল ইসলাহ থেকে ক্রমে দূরে সরে যেতে থাকে এবং ইংরেজি শিক্ষিতদের সমর্থন পেতে থাকে। বাংলাদেশ ও আসামের খ্যাতনামা লেখকবৃন্দের লেখা পত্রিকাটিতে ছাপা হতো। ১৯৩৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সিলেটে ‘কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৯ সালের ২৮ জুন সংসদের কার্যকরী সমিতির বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শর্তসাপেক্ষে আল ইসলাহ-কে সাহিত্য সংসদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তীতে আল ইসলাহ ‘কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ’-এর মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হতে থাকে।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে আল ইসলাহ গৌরবজনক ভূমিকা পালন করে। পাকিস্তান সৃষ্টির পরবর্তী মাসে পত্রিকাটির সম্পাদকীয় অংশে আল ইসলাহ পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে প্রথমবারের মতো সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করে। ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যা আল ইসলাহ-তে মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরীর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় কার্তিক-চৈত্র ১৩৫৬ সংখ্যায়।

আল ইসলাহ-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মুহম্মদ নূরুল হকের ইন্তেকালের সাত বছর পর ১৪০১ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাস থেকে নব কলেবরে আল ইসলাহ প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির প্রকাশনা এখনও অব্যাহত আছে। ১৪০১ বঙ্গাব্দ থেকে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন যথাক্রমে রাগিব হোসেন চৌধুরী, এম এ করিম চৌধুরী, আবদুল হাই মিনার, হারুনুজ্জামান চৌধুরী এবং আবদুল হামিদ মানিক। বর্তমান সম্পাদক সেলিম আউয়াল।  [নন্দলাল শর্মা]