আলী, মোহাম্মদ শামশাদ

আলী, মোহাম্মদ শামশাদ (১৯৩৪-১৯৭১)  চিকিৎসক, শহীদ বুদ্ধিজীবী।  শামশাদ আলী ১৯৩৪ সালের ৯ মার্চ বিহারের এলাহাবাদে তাঁর মাতামহের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস ছিল বগুড়া জেলার সোনাতলায়। তাঁর পিতা আবুল হোসেন ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর থানার মুজাফফরনগরে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলেন। তাঁর মাতা আনোয়ারী বেগম ছিলেন নবাব মুর্শিদকুলি খানের বংশধর।

মোহাম্মদ শামশাদ আলী

পার্বতীপুরে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে শামশাদ আলী রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হন। কিন্তু প্রতিকূল অবস্থার কারণে বাধ্য হয়ে তিনি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ ত্যাগ করে উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় চলে আসেন। তিনি ১৯৬৩ সালে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন।

শামশাদ আলী ১৯৬৩ সালে সরকারের মেডিক্যাল সার্ভিসে যোগ দেন এবং কুমিল্লা থানা হেলথ কমপ্লেক্সে তাঁকে পদায়ন করা হয়। দুই বছর সেখানে চাকরির পর শামশাদ আলী সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে পার্বতীপুরে ব্যক্তিগত চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত হন। পার্বতীপুরে নতুন বাজারে তিনি তাঁর নিজস্ব ফার্মেসি ও চেম্বার প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর বহু অবাঙালিকে পার্বতীপুরে পুনর্বাসন করা হয়। তখন থেকে পার্বতীপুর শহরে এরাই ছিল প্রভাবশালী। সেখানে বাঙালি অবাঙালি (বিহারি) বিরোধ লেগেই ছিল। আইউব বিরোধী আন্দোলন বিশেষত উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানকালে এই বিরোধ প্রকট হয়ে উঠে। আইউব বিরোধী গণআন্দোলনে শামশাদ আলীর অগ্রণী ভূমিকার জন্য তিনি এলাকার অবাঙালিদের আক্রোশের শিকার হন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকবাহিনীর বাঙালি হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে শামশাদ আলী তাঁর পরিবার পরিজন নিয়ে তাদের বাড়িতে অনেকটা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। তাদের বাড়ির চারপাশে ছিল অবাঙালিদের বসতি।

১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল রাত ১১টায় নয় জন পাকসেনার একটি দল কয়েকজন অবাঙালি দালালসহ শামশাদ আলীর বাড়ির দরজায় করাঘাত করে। শামশাদ আলীর এক ভাই দরজা খুলে দিলে সৈন্যরা তল্লাশির অজুহাতে বাড়িতে ঢুকে পড়ে। শামশাদ আলীর পিতামাতাসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের রাইফেলের মুখে তাড়া করে বাইরে এনে এক সারিতে দাঁড় করানো হয়। শামশাদ আলী তখন ছিলেন বাড়ির দোতলায়। তিনি অবস্থা বুঝে দ্রুত ছাদে গিয়ে কার্নিশের আড়ালে লুকান। সৈন্যরা তাঁকে খুঁজে বের করে টেনে নিচে নামিয়ে আনে। তারপর অন্যদের বাড়িতে রেখে একমাত্র শামশাদ আলীকে তারা ধরে নিয়ে যায় শহরের উপকণ্ঠে। প্রতীয়মান হয় যে, তারা শুধু শামশাদ আলীকে ধরার জন্যই বাড়িতে হামলা করে।

জানা যায়, জনৈক অবাঙালি মির্যা খান তার ৩০৩ রাইফেলে একদম কাছে থেকে শামশাদ আলীকে গুলি করতেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাইফেলের নল ধরে ফেলেন। রাইফেল নিয়ে দু’জনের টানাহেচড়ার এক পর্যায়ে পরপর কয়েকটি গুলিতে শামশাদ আলী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তাঁর মৃতদেহ কেটে টুকরা টুকরা করে রেল স্টেশনের উত্তর প্রান্তে একটি রেল ইঞ্জিনের বয়লারের আগুনে পোড়ানো হয়।

প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী শামশাদ আলী ছিলেন সংস্কৃতি চর্চায় অনুরাগী। ক্রীড়াবিদ ও গায়ক শামশাদ আলী পার্বতীপুরে সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখেন। তাঁরই উদ্যোগে পার্বতীপুরে ‘প্রগতি সংঘ’ নামে একটি সংস্কৃতি ও ক্রীড়া সংগঠন গড়ে উঠে।

জাতির জন্য তাঁর আত্মদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পার্বতীপুরের নতুন বাজারে একটি রাস্তার নতুন নামকরণ হয় শহীদ ডাঃ শামশাদ আলী রোড।

বাংলাদেশ সরকারের ডাকবিভাগ জাতির জন্য তাঁর আত্মদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে মোহাম্মদ শামশাদ আলীর নামে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে।  [মুয়ায্‌যম হুসায়ন খান]