আর্ট গ্যালারি

আর্ট গ্যালারি  পাশ্চাত্যে রেনেসাঁ বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে আর্ট গ্যালারির ব্যাপক প্রসার ঘটলেও উপমহাদেশে গ্যালারির ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে  কলকাতায় আনুষ্ঠানিকভাবে শিল্প চর্চা শুরু হয়। ঢাকার নিমতলী প্রাসাদের নায়েব-নাজিমদের পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক চিত্র অঙ্কিত হয়। কলকাতায় চিত্রকর হিসেবে কালীঘাট মন্দিরের শিল্পী এবং বটতলার পুস্তক চিত্রকরদের কথা জানা যায়। ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে বড় বড়  মন্দির কেন্দ্রিক সাংবার্ষিক মেলাগুলিতে নিজস্ব চরিত্রের চিত্রকর্ম দেখা যায়। কিন্তু ঢাকেশ্বরী মন্দিরের মতো প্রাচীন ও বিখ্যাত মন্দিরে কিংবা পুরনো ঢাকার কেতাবপট্টির মুসলমানদের পুস্তকে কোনো শিল্প বা চিত্রকর্ম পাওয়া যায় না। দেশবিভাগপূর্ব ঢাকায় তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য শিল্পী, শিল্পিগোষ্ঠী বা কোনো গ্যালারি প্রতিষ্ঠিত হয় নি। তবে এখানে শিল্পকলার চর্চা যে একেবারে হয়নি তা নয়। আলম মুসাবিবর নামে এক শিল্পী সম্ভবত উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ঢাকার ঈদ ও  মুহররম মিছিলের ৩৯টি জল রং ছবি অঙ্কন করেন। এগুলি  বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর-এ সংরক্ষিত আছে। বাংলাদেশে শিল্পকলার প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার জন্য ১৯৪৮ সালে প্রথম ঢাকায় আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা হলে কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে চারুকলা চর্চার সূত্রপাত হয়। ১৮৭৬ সালে উপমহাদেশের সর্বপ্রথম আর্ট গ্যালারি স্থাপিত হয় কলকাতায়।

ঢাকা আর্ট গ্রুপ নামে একটি সংগঠন ১৯৫১ সালের ১৬ জানুয়ারি ঢাকায় প্রথম চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। তখনো ঢাকায় কোনো স্থায়ী গ্যালারি গড়ে ওঠেনি। উক্ত প্রদর্শনীতে ১৯ জন শিল্পীর ২৪৭টি শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়। শুধু জয়নুল আবেদীন ও শফিউদ্দীন আহমেদ তৈলরং-এর ছবি দিয়ে এ প্রদর্শনীকে অলঙ্কৃত করেন।

৬০-এর দশকে পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা হলে সেখানে একটি আর্ট গ্যালারি সংযুক্ত হয়। এছাড়া ঢাকায় দুটি গ্যালারি স্থাপিত হয়। ঢাকার ধানমন্ডিতে ‘আর্ট অ্যান্ড সিম্বল’ ও ইন্দিরা রোডে ‘দেশ’ গ্যালারি জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ১৯৭০-র দশকে শিল্পানুরাগী আফতাব উদ্দীন আহমদ ঢাকার শাহবাগে জিরাজ আর্ট গ্যালারি প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে নবীন-প্রবীণ সব শিল্পীরই শিল্পকর্ম বিক্রির ব্যবস্থা ছিল। এরকম আরেকটি উল্লেখযোগ্য গ্যালারি হচ্ছে গুলশানের ‘সাজু আর্ট গ্যালারি’।

১৯৮০-র দশকে ঢাকায় গ্যালারির সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যায়। এগুলির কোনো কোনোটি ছিল ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত। বিদেশি দূতাবাসের কালচারাল সেন্টারগুলিতে বেশ কয়েকটি গ্যালারি প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকায় বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি আলোকচিত্র গ্যালারি প্রতিষ্ঠা করে।

বেসরকারি উদ্যোগে ১৯৯০-এর দশকে বেশ কয়েকটি আর্ট গ্যালারি প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০০ সালে ঢাকার প্রায় ১৫টি অভিজাত গ্যালারিতে প্রথমবারের মতো উপমহাদেশে ‘ফার্স্ট ফেস্টিভ্যাল অব ফটোগ্রাফি ইন এশিয়া’ নামে একটি ‘ছবি মেলা’ অনুষ্ঠিত হয়।

২০০৩ সালে শিল্পকলা একাডেমিতে স্থাপিত জাতীয় আর্ট গ্যালারি দেশের সেরা শিল্পকর্ম প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে। দুই তলাবিশিষ্ট আর্টগ্যালারিতে স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর জন্য হল আছে। শিল্পকর্ম সম্পর্কিত জ্ঞান লাভের জন্য ছাত্ররা এর ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করে। সরকারিভাবে ঢাকায় আরো কয়েকটি গ্যালারি আছে যেমন, বঙ্গবীর ওসমানী মিলনায়তন গ্যালারি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর গ্যালারি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী গ্যালারি। সরকারি পর্যায়ে আন্তর্জাতিক চারুকলা ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী এসব গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয়। বিদেশি দূতাবাসের কালচারাল সেন্টারের গ্যালারিগুলির মধ্যে অলিয়ঁস ফ্রঁসেস গ্যালারি, গ্যাটে ইনস্টিটিউট গ্যালারি, ভারতীয় হাইকমিশন কালচারাল সেন্টার গ্যালারি, রাশিয়ান কালচারাল সেন্টার গ্যালারি আন্তর্জাতিক মানের। এ ছাড়া রয়েছে সোনারগাঁও হোটেলের ডিভাইন আর্ট গ্যালারি, চারুকলা ইনস্টিটিউটের জয়নুল গ্যালারি ও এশিয়াটিক সোসাইটির আর্ট গ্যালারি।

বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে পৃথিবীর সেরা প্রেস ফটোগ্রাফারদের ‘ওয়ার্ল্ড প্রেসফটো’ প্রদর্শনী নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দ্বি-বার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঢাকার অভিজাত গ্যালারিগুলিতে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বর্তমানের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্যালারি হচ্ছে দৃক গ্যালারি, বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টস, শিল্পরাগ, সমকালীন চিত্রশালা, চিত্রক ও এরিয়াল। ঢাকায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গ্যালারি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এবং গ্যালারির সংখ্যা বাড়ছে।

[বায়েজীদ আকতার]