আরব

আরব  বাঙালি জীবনের বিভিন্নক্ষেত্রে এবং দেশের আনাচে-কানাচে আরবদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বাংলা, বাঙ্গালা, বেঙ্গালা, বেঙ্গল আরবি ভাষা হতে উৎপন্ন শব্দ। মুলক বাঙ্গাল (দেশ), খালিজ-বাঙ্গাল (উপসাগর), হুজ্জাত-ই-বাঙ্গাল প্রাচীন আরবি প্রবাদ শব্দ ভান্ডার। আম্মা (মা), আববা (বাবা) খাঁটি আরবি শব্দ। এ শব্দ দুটি বাংলাদেশের মুসলিমগণ সাধারণত ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেন। নোয়াখালীতে জনপ্রিয় কতগুলি শব্দ আরবি ভাষা হতে উদ্ভূত। চট্টগ্রামে ডাকের উত্তর দেওয়ার পুরানো রীতি ‘লাববাই’ আরবি ‘লাববাইক’ হতে উৎপত্তি হয়েছে। এভাবে স্মরণাতীতকাল হতে বাংলাদেশের পরিভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের ওপর আরবি ভাষা প্রভাব বিস্তার করেছে। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও সিলেটের স্থানীয় লোকেরা জিন ও বন্য জন্তুর ভয়ে জঙ্গল এলাকায় বসতি স্থাপন করতে ভীতসন্ত্রস্ত ছিল। অলি-আউলিয়াদের পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম বসতি স্থাপনকারীরা এসব অঞ্চলে বসতি স্থাপন করতে সাহসী হয়। অলি-আউলিয়াগণ বসতিসমূহে সমাহিত আছেন এবং তাঁদের কবরস্থানগুলি মাযার হিসেবে সম্মানিত হয়ে আসছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে মুসলমানদের যোগাযোগ দুপর্যায়ে সাধিত হয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে আট শতক হতে বারো শতক পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে তেরো শতক হতে সামনের দিকে। সমুদ্রগামী আরব ব্যবসায়ী ও পর্যটকগণ প্রথম পর্যায়ে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। তারা কর্তব্যানুরোধে ধর্ম শিক্ষা দেন এবং তা প্রচার করেন। এটা ছিল শান্তিপূর্ণ ও শান্তিপ্রয়াসী প্রচেষ্টা। এ সংঘটন সুস্পষ্ট কিন্তু এর প্রমাণাদি অপ্রতুল।

তাসত্ত্বেও, দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ার দেশসমূহ সম্পর্কে ব্যবসায়ী সুলায়মান (আনুমানিক ৮১৫ খ্রি.), জায়েদ-আল-হাসান, ইবনে খুরদাদবিহ (মৃত্যু ৯১২ খ্রি.), আল মাসুদী (মৃত্যু ৯৫৬ খ্রি.) ইবনে হাওকল (আনুমানিক ৯৭৬ খ্রি.) ভূগোলবিদ আল-ইদ্রিসী (আনু. ১১০০-১১৬৫ খ্রি.) এবং অন্যান্যদের দ্বারা প্রণীত সমসাময়িক বাণিজ্যিক প্রতিবেদন, ভ্রমণকাহিনী, ঐতিহাসিক বিবরণ ও ভৌগোলিক বর্ণনাসমূহে স্পষ্টত প্রমাণিত হয় যে, আট শতক হতে বারো শতক পর্যন্ত বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল, বিশেষত মেঘনা নদীর পূর্বাঞ্চল পারস্য-আরব ব্যবসায়ের ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। সাত শতকে  মুসলমানদের হাতে সাসানিদ সাম্রাজ্যের পতনের পর সমস্ত পারসিক ব্যবসা মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং কালক্রমে উদীয়মান আরব বণিকগণ সামুদ্রিক বাণিজ্যের কর্তৃত্বকে নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। আববাসীয় খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় খ্রিস্টীয় নয় শতকের প্রথম হতে আরবরা গভীর সমুদ্রে নিয়মিতভাবে যাতায়াত শুরু করে। খ্রিস্টীয় নয় শতক হতে ষোল শতক পর্যন্ত সময়ে স্প্যানিশ জিব্রালটার থেকে চীনের ক্যান্টন বন্দর পর্যন্ত পারস্য-আরবদের সামুদ্রিক বাণিজ্যের ছিল স্বর্ণযুগ। সমুদ্র বিষয়ক ঐতিহাসিক হাদী হাসান-এর মতে, আরব, পারসিক, আবিসিনিয়ান, ভারতীয় এবং অন্যান্যরা বাংলাদেশে বসতি স্থাপন করতেন। এদেশের ভূমি উর্বর এবং জলবায়ু স্বাস্থ্যকর ছিল। তাদের অধিকাংশই বড় ব্যবসায়ী ছিলেন এবং তাদের নিজেদের জাহাজ ছিল। বাংলার বন্দরসমূহের মধ্যে সমন্দর খুবই গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল। এ বন্দরকে আধুনিক চট্টগ্রাম বন্দর বলে শনাক্ত করা হয়। কামরূপ ও অন্যান্য স্থান থেকে নদী পথে ১৫ অথবা ২০ দিনে রপ্তানির জন্য চন্দন কাঠ এ বন্দরে আনা হতো। এ বন্দরের চারপাশে প্রচুর ধান উৎপন্ন হতো। সম্ভবত ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর সঙ্গমস্থলের কোনোখানে সমন্দর বন্দর অবস্থিত এবং মনে হয় সমুদ্র কিংবা সন্দ্বীপ হতে এর দূরত্ব একদিনের।

বাংলাদেশের সাথে আরবদের যোগাযোগের আরেকটি সম্ভাব্য পথ ছিল বঙ্গোপসাগরের দীর্ঘ উপকূল অঞ্চল, যার মধ্য দিয়ে আরব বণিকদের বাণিজ্যিক জাহাজগুলিকে অতিক্রম করতে হতো। এ সময় তারা বনে উৎপাদিত উৎকৃষ্টমানের বস্ত্ত এবং মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য পণ্যদ্রব্যাদি সংগ্রহ ও ক্রয় করত। এগুলি পূর্ব ভারতের দূরবর্তী এলাকা আসাম, কামরূপ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে আনা হতো। ওলন্দাজ ঐতিহাসিক ভন লেউর (Van Leur) ধারণা করেন যে, বাংলার উপকূলীয় এলাকায় আরাকান ও অন্যান্য স্থানে আরবদের অসংখ্য বসতি ও আড়ত ঘর ছিল। এখানে তারা স্থানীয় উৎপাদিত বস্ত্ত ও পণ্যদ্রব্যাদি রপ্তানির জন্য সংগ্রহ করার কাজে ব্যস্ত থাকতেন।

বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার অংশবিশেষ নিয়ে বর্তমানে যে সব অঞ্চল রয়েছে প্রাচীনকালে সেসব অঞ্চল আরাকান রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। ৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের রাজা সু-ল-তইং সান-দ-ইয়া ‘থু-র-তন’ (বাংলা) জয় করে সে দেশে একটি বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করেন। এ বিজয়স্তম্ভের শিলালিপিতে লেখা ছিল ‘সেট-ত-গোইং’ অর্থাৎ যুদ্ধ করা অনুচিত। কোনো কোনো পন্ডিতব্যক্তি মনে করেন যে, চিটাগাং নামটি ‘সেট-ত-গোইং’ হতে উদ্ভব হয়েছে। আরও ধারণা করা হয় যে, ‘সু-র-তন’ ‘সুরতন’ (Tsu-ra-tan) শব্দটি সুলতান শব্দের আরাকানি অপভ্রংশ। এতে বোঝা যায় যে, দশ শতকের মাঝামাঝি চট্টগ্রাম এলাকায় সম্ভবত একটি মুসলিম সম্প্রদায় বসতি স্থাপন করেছিল এবং আরাকানের রাজাকে শক্তি প্রয়োগ করে তাদের দমন করতে হয়েছিল। কেউ কেউ আরও দাবি করেন যে, ওই এলাকায় একটি ছোট মুসলিম রাজ্যও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এ রাজ্যটিকে আরাকানের রাজা দমন করেছিলেন। সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদির অভাবে মুসলিম ক্ষুদ্র রাজ্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিন্ত করে কিছু বলা সম্ভব নয়। কিন্তু এ অঞ্চলে অত্যধিক মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠতা ও বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব এলাকায় মুসলিম জনগণের শারীরিক বৈশিষ্ট্যাবলি বিবেচনা করলে এ ধরনের একটি সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বাংলাদেশের সঙ্গে আরবদের বাস্তব যোগাযোগ নওগাঁ জেলায় পাহাড়পুরে প্রাপ্ত একটি স্বর্ণমুদ্রা এবং কুমিল্লা জেলার ময়নামতীতে প্রাপ্ত আববাসীয় খলিফাদের দুটি মুদ্রা (একটি স্বর্ণের ও অপরটি রৌপ্যের) দিয়ে নির্ণয় করা যায়। পাহাড়পুরে প্রাপ্ত স্বর্ণমুদ্রাটি ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দের এবং এতে খলিফা হারুন-অর-রশিদের নাম রয়েছে। মুদ্রাটি পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে পাওয়া গেছে। একটি অনুরূপ স্বর্ণমুদ্রা ও একটি রৌপ্য মুদ্রা ময়নামতীর লালমাই-এর শালবনবিহারের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে পাওয়া গেছে। স্বর্ণমুদ্রাটি আববাসীয় খলিফা মোস্তাকিমবিল্লাহ্ (১২৪২-১২৪৫ খ্রি.)-এর শাসনামলে তৈরি হয়েছে। রৌপ্য মুদ্রাটি আংশিক ক্ষয়প্রাপ্ত এবং এর তারিখ নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয় নি।

এ সকল তথ্য যথার্থভাবে প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের সঙ্গে আরবদের নিবিড় ও ধারাবাহিক বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের কোথাও ব্যাপকহারে আরবগণ যে বসতি স্থাপন করেছে, তা স্পষ্ট করে বলা যায় না। যাহোক, কিছু প্রচলিত বংশবৃত্তান্তে উল্লেখ পাওয়া যায় যে, সৈয়দ আলাউদ্দীন হোসেন শাহ বাংলায় ক্ষমতায় আসার পর (১৪৯৪-১৫১৯ খ্রি.) নিজের শক্তি বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে আরবদেরকে বাংলাদেশে বসতি স্থাপন করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এ কারণে বহু আরব পরিবার হোসেন শাহের দরবারে ভিড় জমায়। তবে তাদের সংখ্যা ছিল খুবই কম।  [মুইন-উদ্-দীন আহমদ খান]

গ্রন্থপঞ্জি  Abdul Karim (Sahityavisharad) and Muhammad Enamul Haq, Arakan Rajshabhaya Bangla Sahitya, Calcutta, 1935; AM Chowdhury, Dynastic History of Bengal, Dhaka, 1967; Elliot and Dowson, History of India as told by its own Historians, I; A Karim, Social History of the Muslims of Bengal, 2nd ed. Chittagong, 1983; Muhammad Mohar Ali, History of the Muslims of Bengal, IA, Riyadh, 1985; SB Qanungo, A History of Chittagong, Chittagong, 1988; SH Hodivala, Studies in History of Indian Muslim, New Delhi (Reprint), 1992.