আরউইন, লর্ড

আরউইন, লর্ড (১৮৮১-১৯৫৯) ৩ এপ্রিল ১৯২৬ থেকে ১৮ এপ্রিল ১৯৩১ সাল পর্যন্ত ভারতের গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয়। হ্যালিফ্যাক্সের দ্বিতীয় ভাইকাউন্টের পুত্র লর্ড এডওয়ার্ড ফ্রেডারিক লিন্ডলে উড আরউইন ইটনে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ১৯১০ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন। ওই সময় তিনি মন্ত্রিসভায় অনেকগুলি পদ অলংকৃত করেছিলেন। ১৯২৬ সালে তাঁকে ভারতের গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় নিয়োগ করা হয়। এ পদে তিনি ১৯৩১ সাল পর্যন্ত অধিষ্ঠিত ছিলেন। আরউইন ভাইসরয় থাকাকালে ভারতের রাজনৈতিক জীবনে প্রচন্ড আলোড়নের সৃষ্টি হয়।  সাইমন কমিশন রিপোট, নেহরু রিপোর্ট, সর্বদলীয় সম্মেলন, জিন্নাহ্র ১৪ দফা, আইন অমান্য আন্দোলন, গোলটেবিল বৈঠক, এবং আরও কিছু সমস্যা তাঁর শাসনামলকে চরমভাবে ঝঞ্ঝাপূর্ণ করে তোলে। প্রকৃতপক্ষে সাইমন কমিশন থেকে ভারতীয় নেতাদের বাদ দেওয়া থেকে শুরু করে একের পর এক সংকট দেখা দেয়। একটি সংকট মোকাবিলা করার পরিণতি হিসেবে নতুন নতুন সংকটের উদ্ভব হয়। আরেকটিন বড় সমস্যা ছিলো ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস এর বিচার্য বিষয়টি সম্পর্কে ভারতীয় নেতৃব„ৃন্দর দৃষ্টিভঙ্গী এবং ইন্ডিয়া কাউন্সিলের প্রদত্ব ব্যাখ্যার মধ্যে ভিন্নতা। ১৯৩০ সালের এপ্রিল মাসে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করে। সমাগত শাসনতন্ত্রে মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকারসমূহ ন্যায্যভাবে প্রতিফলিত না হলে মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানগণ কর্তৃক আইন অমান্য আন্দোলনের হুমকি দেন।

লর্ড আরউইন

আরউইন এসব রাজনৈতিক সমস্যা ধৈর্য্য ও কৌশলের সঙ্গে মোকাবিলা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু অবস্থা পরম্পরা এত বিভ্রান্তিকর ছিল যে, অভূতপূর্ব রাজনৈতিক ঘটনাসমূহের বিকাশ যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে সেখানে সনাতন কূটনীতি ও চাতুর্য অকার্যকর হয়ে পড়ে। হিন্দু, মুসলমান, ইঙ্গ-ভারতীয় সম্প্রদায়, চরমপন্থি, দেশিয় রাজ্যসমূহ সকলেই ভারত শাসন আইন প্রণয়নের পূর্বে তাদের দাবি মিটানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। সংকটটি আরও জটিল হয়ে পড়ে এ কারণে যে, প্রত্যেক সম্প্রদায়কে নেতৃত্বদানকারী দলগুলি ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রে যে আন্তঃসাম্প্রদায়িক মর্যাদা দেওয়া হবে সে বিষয়ে তারা বিপরীত ধারণা পোষণ করত। সবচেয়ে সংগঠিত দল কংগ্রেস অনেকগুলি স্বার্থকে প্রতিনিধিত্ব করত বলে তারা সকলেই চাইত যে ভাইসরয় তাদের কথা শুনুন। কিন্তু বাস্তবে কংগ্রেসের স্বার্থান্বেষী সকল গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করা প্রায় অসম্ভব ছিল।

এ পর্যায়ে এসে আরউইন কৌশল হিসেবে কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দকে কারাবন্দী করেন এবং তারপর গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। তাঁর এ কৌশলটি ফলপ্রসু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩১ সালে গান্ধী-আরউইন চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তির প্রধান শর্তসমূহ ছিলো নিম্নরূপ:

কংগ্রেস গোল টেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করবে এবং আইন অমান্য আন্দোলন বর্জণ করবে।

সরকার কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদের উপর আরোপিত সকল কানুনি অভিযোগ ও আইন তুলে নিবে;

আইন অমান্য আন্দোলনকালে আটককৃত সকল রাজবন্দীকে সরকার মুক্তি দিবে;

চুক্তিতে আরও ঐকমত্য হয় যে, কংগ্রেসের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে গান্ধী দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিবেন;

উল্লেখ্য যে, কংগ্রেস প্রথম গোল টেবিল বৈঠক বর্জন করেছিলো। গান্ধী-আরউইন চুক্তির এক মাসের মধ্যে আরউইন অবসরে যান এবং ভারত ত্যাগ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত হিসেবে তাঁর নতুন দায়িত্ব গ্রহন করেন।

মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে লর্ড আরউইন অতি উচ্চ ধারনা পোষণ করতেন এবং ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে বিভিন্ন সরকারী অনুষ্ঠানে বহুবার তিনি গান্ধীর প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধার কথা ব্যাক্ত করেন। আরউইন রাজনীতির চাইতে তাত্ত্বিকতাকে ভালোবাসতেন। মাস্টার অব মিডলটন হান্ট হওয়ার ইচ্ছায় তিনি ১৯৩২ সালে বিদেশ দূতাবাসের দূত পদ গ্রহণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরবর্তীতে তাঁকে বিদেশ বিষয়ের সেক্রেটারি পদ প্রদান করা হয় এবং ১৯৩৮ ধেকে ১৯৪০ পর্যন্ত তিনি এ পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। তিনি উত্তোরাধিকার সূত্রে পিতার নিকট থেকে ভাইকাউন্ট হ্যালিফ্যাক্স পদবীটি লাভ করেন।  লর্ড আরউইন ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত হাউজ আব লর্ডস এর নেতৃত্বে ছিলেন।  তিনি ১৯৩৩ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন এবং ২৩ ডিসেম্বর ১৯৫৯ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।  [সিরাজুল ইসলাম]