আয়ুর্বেদিক ঔষধ

আয়ুর্বেদিক ঔষধ (Ayurvedic Medicine) রোগব্যাধি নিরাময়ের জন্য ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি। ব্রিটিশদের ভারত আগমনের সময় ভারতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে ছিল আয়ুর্বেদ, ইউনানি, সিদ্ধ ও নানা ধরনের লোকজ চিকিৎসা পদ্ধতি। উনিশ শতকে বাংলার আয়ুর্বেদিক পেশাজীবী বা কবিরাজরা প্রধানত ছিলেন উচ্চবর্ণের হিন্দু পরিবারের সদস্য এবং সংস্কৃত ভাষায় দক্ষ। কবিরাজ ও রোগীদের মধ্যে এক ধরনের প্রথাগত সম্পর্ক ছিল। ব্যাধি শনাক্তকরণ ছাড়াও কবিরাজ ঔষধ সেবনের সময় রোগীকে যথাযথ খাদ্য-পথ্য গ্রহণ ও অন্যান্য আচরণ বা নিয়ম-কানুন মেনে চলার পরামর্শ দিতেন। ঔষধের উপাদানসমূহের বিশুদ্ধতা এবং ঔষধ প্রস্ত্ততের যথাযথ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কবিরাজ শুধু নিজ হাতে তৈরী বা তাঁর নিজের তদারকিতে প্রস্ত্তত ঔষধ রোগীকে দিতেন। খ্যাতিমান আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকগণ টোলে শিক্ষার্থীদের প্রাচীন সংস্কৃত পাঠ থেকে শিক্ষা দিতেন। শিক্ষার্থীরাও রোগীদের চিকিৎসা ও ঔষধ তৈরীর কাজে কবিরাজদের সহযোগিতা করত এবং এভাবে প্রয়োজনীয় প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা অর্জন করত। উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গে মানসিক রোগ চিকিৎসার জন্য বিখ্যাত আয়ুর্বেদ চিকিৎসা কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রামে ও খানদারপাড়ায়, চান্দসিতে ছিল একটি যেখানে বিভিন্ন ধরনের ক্ষত, ফোঁড়া, অর্শ ও ভগন্দর চিকিৎসা করা হতো। পশ্চিমবঙ্গের কুমারটুলি ও মুর্শিদাবাদ ছিল যথাক্রমে ঔষধ তৈরি, নাড়ি দেখা ও রোগনির্ণয়ের জন্য বিখ্যাত।

উনিশ শতকের প্রথম কয়েক দশকে ভারতীয় ও পাশ্চাত্য চিকিৎসা ব্যবস্থা পাশাপাশি প্রচলিত ছিল। পাশ্চাত্য চিকিৎসা গবেষকদের মধ্যে এ দেশিয় চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি ব্যাপক আগ্রহ দেখা যায়। আঠারো শতকের শেষ নাগাদ চিকিৎসাবিদ্যা ভারতীয় সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত হয়। প্রাচ্য বিশারদগণ জোরালোভাবে যুক্তি দেন যে চিকিৎসাবিদ্যার এক প্রাচীন ব্যবস্থা ভারতে রয়েছে যা অনুসন্ধানযোগ্য এবং এ জ্ঞান পুনরাবিষ্কারের লক্ষ্যে প্রাচীন সংস্কৃত পান্ডুলিপিসমূহ অন্বেষণের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। প্রাচ্যবিদ স্যার উইলিয়ম জোনস-এর মতো বিদ্বজ্জনের প্রচেষ্টার ফলেই মূলত চিকিৎসাবিদ্যা বিষয়ক প্রাচীন রচনাদি সমালোচনামূলক ও সংগঠিত অনুসন্ধানের বিষয়ে পরিণত হয়।

জোনস-এর পরবর্তী সময়ের লেখকগণ, যেমন: জে জনসন, বি হাইনে, এইচ উইলসন, ডব্লিউ আইনসলি, ডব্লিউ টারনিং, জি প্লেফেয়ার, জে আর মার্টিন, জে এফ রয়েল এবং টি ডব্লিউ ওয়াইজ বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যার অতীতের মহিমা ও সাফল্যের সঙ্গে তার পরবর্তীকালের অধোগতির তুলনা করেন। তথাপি উনিশ শতকের গোড়ার কয়েক দশকে ভারতের সমৃদ্ধ চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কে জানার আগ্রহ ইউরোপীয়দের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। চিকিৎসাবিদ্যা বিষয়ক প্রাচীন রচনাদি পাঠ ও দেশিয় চিকিৎসকদের সঙ্গে আলাপের মাধ্যমে তারা জ্ঞান লাভের চেষ্টা করতেন। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষাদানের জন্য প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। বাংলায় দেশিয় বিদ্যা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ১৮১১ সালে লর্ড মিন্টো সরকারি আনুকূল্যে নদীয়া ও তীরহাটে কলেজ স্থাপনের সুপারিশ করেন। সেনাবাহিনীতে কাজের জন্য দেশিয় চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দানের লক্ষ্যে কলকাতায় ১৮২২ সালে চিকিৎসা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ১৮২৬ সালে সংস্কৃত কলেজ ও কলকাতা মাদ্রাসার সেক্রেটারিগণ তাঁদের প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসাবিদ্যার ক্লাস পরিচালনার জন্য সরকারি নির্দেশনা বিষয়ক জেনারেল কমিটির প্রতি আবেদন জানান। সংস্কৃত কলেজের সেক্রেটারি ডব্লিউ প্রাইস জেনারেল কমিটির কাছে লিখিত আবেদনপত্রে উল্লেখ করেন যে, কলেজের ছয় জন ছাত্র ও বৈদ্য গোত্রের ১২ জন বহিরাগত কলেজে চিকিৎসাবিদ্যার ক্লাস প্রবর্তনের আবেদন জানিয়েছেন, যাতে তারা পরবর্তীকালে চিকিৎসা পেশা গ্রহণের প্রয়োজনীয় শিক্ষা লাভ করতে পারেন। নেটিভ মেডিক্যাল ইনস্টিটিউশনের সুপারিনটেনডেন্ট জন টিটলার ক্লাস পরিচালনার দায়িত্ব নেন এবং পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ দান শুরু করেন। আয়ুর্বেদিক বিদ্যাও শেখানো হয় এবং পাঠ্যতালিকায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত ছিল সুশ্রুত ও চরক-সংহিতা।

১৮৩৫ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর আয়ুর্বেদিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি সরকারি আনুকূল্যের অভাব এবং অর্থসঙ্কটে পড়ে। গঙ্গাধর রায় (১৭৮৯-১৮৮৫), গঙ্গাপ্রসাদ সেন (১৮২৪-১৮৯৬) প্রমুখ বিশিষ্ট আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ও তাঁদের শিষ্যরা বাংলায় দেশিয় চিকিৎসাবিদ্যার গুরুত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করেন। গঙ্গাধর রায় ১৭৮৯ সালে যশোরের একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং রমাকান্ত সেনের টোলে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাবিদ্যায় শিক্ষালাভ করেন। শিক্ষা শেষে তিনি পেশা শুরুর লক্ষ্যে কলকাতা যান। তাঁর কলকাতা যাওয়ার আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল বিখ্যাত সংস্কৃত রচনা ‘চরক-সংহিতা’ প্রকাশ করা। কলকাতা গিয়ে তিনি জানতে পারেন যে, সেখানকার এক ব্যক্তির কাছে চরক-সংহিতার একটি নির্ভুল কপি রয়েছে। গঙ্গাধর রায় ১৮১৯ থেকে ১৮৩৫ পর্যন্ত কলকাতায় ছিলেন। সেখানকার আবহাওয়া তাঁর স্বাস্থ্যের অনুকূল ছিল না বলে তিনি সে শহর ত্যাগ করেন। অতঃপর বহরমপুরের সাঈদাবাদে আবাস গড়েন। তিনি শিষ্যদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে নিজের বাড়িতে একটি টোল খোলেন। গঙ্গাধর নাড়ি দেখে রোগ নির্ণয় ও বিষের ভেষজ ব্যবহারের জন্য খ্যাতি লাভ করেন। চরক-সংহিতা সম্বন্ধে সুবিখ্যাত আলোচনা জল্পকল্পতরু লিখে এবং অন্যান্য সংস্কৃত রচনাদির ওপর ব্যাখ্যা-আলোচনা লেখার মাধ্যমে তিনি আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বিরাট অবদান রাখেন। ১৮৮৫ সালে তিনি মারা যান, কিন্তু শিষ্যরা তাঁর কর্ম অব্যাহত রাখেন।

গঙ্গাধর পশ্চিমা চিকিৎসা শাস্ত্রের সংস্রব এড়িয়ে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাশাস্ত্রের আদি বিশুদ্ধতা রক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন। অন্যদিকে তাঁর একজন কনিষ্ঠ সমসাময়িক গঙ্গাপ্রসাদ সেন পশ্চিমা চিকিৎসাবিদ্যার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে আয়ুর্বেদিক ঔষধকে জনপ্রিয় করার পথ বেছে নেন। তিনি নির্ধারিত মূল্যে ঔষধ বিক্রয় করতেন, চিকিৎসকের পরামর্শ ফি নিতেন, যা কখনও কখনও অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকদের ফি-এর চেয়েও বেশি হতো। তিনি ঔষধের বিজ্ঞাপন প্রচার করতেন, এমনকি ঔষধ রপ্তানিও করতেন। তিনি আয়ুর্বেদ বিষয়ে প্রথম বাংলা পত্রিকা আয়ুর্বেদ সঞ্জীবনী  প্রকাশ করেন।

উনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে দেশিয় চিকিৎসাবিদ্যার পুনরুজ্জীবনের যে আন্দোলন চলে তার মূলত তিনটি রূপ ছিল: প্রাচীন ও পরবর্তীকালীন আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রাদিতে প্রাপ্ত জ্ঞান সংকলন ও তার প্রচার, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান এবং আয়ুর্বেদিক ঔষধ প্রস্ত্ততকরণ ও বিপণন। গঙ্গাপ্রসাদ সেনের একজন ছাত্র বিজয়রত্ন সেন আয়ুর্বেদ সম্বন্ধে তিনটি প্রাচীন সংস্কৃত রচনার একটি অষ্টাঙ্গহূদয় বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি একটি টোলে শিক্ষালাভ করেন, তবে ইংরেজি শিখেছিলেন এবং অ্যালোপ্যাথি সম্পর্কে কিছু জ্ঞান আহরণ করেছিলেন। তিনি অ্যালোপ্যাথি ও আয়ুর্বেদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের একটি ধারার সূচনা করেন যা তাঁর ছাত্র যামিনীভূষণ রায় আরও এগিয়ে নিয়ে যান। গঙ্গাধরের একজন কনিষ্ঠ সমসাময়িক চন্দ্রকিশোর সেন ১৮৭৮ সালে কলকাতায় একটি ছোট্ট ডিসপেনসারি খোলেন। সেখানে তিনি স্বল্পমূল্যে ঔষধ বিক্রয় করতেন। বিশ বছরের মধ্যে সি কে সেন অ্যান্ড কোম্পানি একটি বড় মাপের ঔষধ প্রস্ততকারক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ১৮৮৪ সালে কলকাতায় এন এন সেন অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হয়। সমসাময়িক অনুরূপ অন্যান্য ঔষধ প্রস্ত্ততকারী প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঢাকার শক্তি ঔষধালয়, সাধনা ঔষধালয়, গণনাথ সেন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কল্পতরু আয়ুর্বেদিক ওয়ার্কস ইত্যাদি। এসব প্রতিষ্ঠান বেশ খ্যাতি লাভ করেছিল এবং বাণিজ্যিকভাবে সফল ছিল। যামিনীভূষণ রায় ১৯১৬ সালে অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদ কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল আয়ুর্বেদশাস্ত্রের শিক্ষার্থীদের পশ্চিমা অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, শৈল্যচিকিৎসা ও ধাত্রীবিদ্যা বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেওয়া।

বিশ শতকের গোড়ার দিকে আয়ুর্বেদিক আন্দোলন রাজনৈতিক অবস্থান থেকে নিজের অধিকারের বিষয়গুলি তুলে ধরে। এ আন্দোলন রাজনৈতিক সুবিচার, বৈধতা এবং সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতা আদায়ের চেষ্টা করে। ১৯০৭ সালে নিখিল ভারতীয় আয়ুর্বেদিক কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ফলে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্রের পুনরুজ্জীবনের আন্দোলন বেগবান হয়। এ আন্দোলন ক্রমশ জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গৌড়ীয় সর্ববিদ্যায়তন। সেখানে বৈদ্যশাস্ত্র পীঠ নামে একটি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাশাস্ত্রের শাখা ছিল। ১৯২২ সালে কবিরাজ রামচন্দ্র মল্লিক কাসিমবাজারের মহারাজা স্যার মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দীর আনুকূল্যে গোবিন্দ সুন্দরী আয়ুর্বেদিক কলেজ স্থাপন করেন। সেখানে পশ্চিমা চিকিৎসাবিদ্যা ও আয়ুর্বেদশাস্ত্র পাশাপাশি পড়ানো হতো। ১৯৩২ সালে কবিরাজ গণনাথ সেনের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বনাথ আয়ুর্বেদ মহাবিদ্যালয়-এ অনুরূপ কোর্স চালু করা হয়।

আয়ুর্বেদ আন্দোলনের ফলে সাফল্যজনকভাবে কতকগুলি প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয় যেখানে দেশিয় ও পশ্চিমা চিকিৎসাবিদ্যা পাশাপাশি শিক্ষা দেওয়া হতো। কিন্তু দেশিয় চিকিৎসাশাস্ত্রের পুনরুজ্জীবন বা পশ্চিমা চিকিৎসাশাস্ত্রের সমান সরকারি মর্যাদা লাভে সে আন্দোলন ব্যর্থ হয়। উপরন্তু ঐতিহ্যবাহী আয়ুর্বেদের শুদ্ধতা রক্ষার পক্ষপাতী এবং দেশিয় ও পশ্চিমা চিকিৎসাবিদ্যার একীভূতকরণের পক্ষপাতীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে আয়ুর্বেদ আন্দোলন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে, যা ১৯৪৭ সালের পরবর্তীকালেও অব্যাহত ছিল।  বাংলাদেশেও আয়ুবে©র্দক চিকিৎসার জনপ্রিয়তা ক্রমশ লোপ পাচ্চে।  [সুজাতা মুখার্জী]