আমিল

আমিল জেলার আমলগুজার-এর অনুরূপ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, যিনি পরগণাসমূহের ভূমির জরিপ, রাজস্ব সংগ্রহ এবং সহজ মূল্য নির্ধারণের কাজের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। প্রধানত রাজস্ব সংক্রান্ত কাজের জন্য নির্ধারিত ব্যক্তি। সম্রাট আকবর তাঁর সুবাহ সমূহ একাধিক জেলা বা সরকারে বিভক্ত করেন। সরকারকে কয়েকটি পরগণায় বিভক্ত করা হয়। আকবর, রাজস্ব ও মূল্য নির্ধারণের জন্য জরিপ সম্পন্ন করে আমিল বা আমলগুজার-এর উপর নতুন রাজস্ব প্রশাসনের দায়িত্ব অর্পন করেন। আমিল ছিলেন ফৌজদারের পরে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। স্থানীয় জেলা বা গরগণার রাজস্ব বিভাগের যাবতীয় দায়িত্ব কেন্দ্র থেকে নিয়োগকৃত আমিল-এর উপর ন্যস্ত থাকত। মুগল আমলে কয়েকটি ডিহি বা গ্রামের সমন্বয়ে যে পরগণার সৃষ্টি তাই ছিল মুগলদের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রাথমিক ভিত্তি।

একজন আমিল-এর দায়িত্ব কেবল মূল্যনির্ধারণ ও রাজস্ব সংগ্রহের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত না, তাকে অসৎ কৃষক বা ডাকাতদের অসততার জন্য সাজা প্রদান করতে হতো। আমিল তাঁর এলাকার মোট আবাদযোগ্য জমির হিসাব, তার পরীক্ষা, মাটির প্রকৃতি এবং উৎপাদিত শস্যের সম্ভাব্য মূল্য পরীক্ষার পর রাজস্ব নির্ধারণ করতেন। তাছাড়াও এ সমস্ত মূল্যনির্ধারণী ও রাজস্ব আদায়ের প্রক্রিয়াটি সহজ ও স্বাভাবিকভাবে সম্পন্ন হয় কীনা, তাও লক্ষ্য রাখতে হতো আমিলকে। কারণ, রাষ্ট্রকর্তৃক নির্ধারিত অর্থের বাইরে কৃষকের নিকট থেকে রাজস্ব আদায় করে  কোনো কর্মচারীর প্রতি যাতে কোনো অবিচার না হয় তা লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব ছিলো আমিলদের ওপর। আইন-ই আকবরীর সূত্রানুযায়ী, আমিল-এর দপ্তরে পরগণার প্রত্যেক কৃষকের সহজ প্রবেশাধিকার ছিল। আকবর-এর শাসনামলে প্রধানত আমিলই ছিলেন জমির মূল্যনির্ধারণের জন্য সরাসরি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তাছাড়া সাধারন অন্যান্য প্রশাসনিক কাজও আমিলকে সম্পন্ন করতে হতো।

আমিল একজন গ্রাম্যপ্রধানের সহায়তায় রাজস্ব আদায় করতেন। গ্রাম্যপ্রধান মূল আদায়কৃত রাজস্বের আড়াই শতাংশ কমিশন পেতেন। যদি রাজস্ব সংগ্রহ কোনো কারণে কম হতো, তবে গ্রাম্যপ্রধানের কমিশনের পরিমাণ নির্ধারিত হতো তাঁর কাজের উপর ভিত্তি করে। আমিল তাঁর প্রাত্যহিক কাজের বর্ণনা ও খরচসমূহ মাসিক হিসেবে রাজসভায় প্রেরণ করতেন এবং দুই লাখ দাম (আকবর-এর সময়ের তাম্রমুদ্রাকে বলা হতো দাম, যার মূল্য ছিল এক রৌপ্য মুদ্রার চল্লিশ ভাগের এক ভাগ) সংগৃহীত অর্থও কেন্দ্রে প্রেরণ করতেন।

স্বত্ত্বনিয়োগকারীদের পদবী পরীক্ষা, সুয়োরঘল ভোগদখলকারীদের অংশ পরিদর্শণ ও জেলার জাগীর প্রদানকৃত জমির তত্ত্বাবধানের দায়িত্বও আমিল পালন করতেন। জেলার ভূমি জরিপ ও মূল্যনির্ধারণ সম্পন্ন হওয়ার পর আমিল তার সারসংক্ষেপ পনেরো দিনের মধ্যে দীউয়ানের নিকট প্রেরণ করার নিয়ম প্রচলিত ছিলো। তাছাড়া  জায়গিরদারের তত্ত্বাবধানে নিয়ন্ত্রিত সাধারণ ও তার প্রতিবেশী অঞ্চলের মানুষের অবস্থা, বাজারের হালচাল, জমি ভোগদখলকারীদের অধীনস্ত জমির ভাড়া, জেলার নি:স্ব-দরিদ্রদের অবস্থা, ইত্যাদির মাসিক রিপোর্ট রাজধানীতে প্রেরণ করতেন। আমিলের দপ্তর কর্তৃক আদায়কৃত রাজস্বের হিসাব যথার্থভাবে নিরীক্ষণ করা হতো। কখনো কখনো নির্ধারিত মূল্যের অধিক মূল্য আদায় করা হলে এবং হিসাবে তা প্রমাণীত হলে ওই অতিরিক্ত অর্থ রাষ্ট্রের বাকী হিসেবে পরিগণিত হতো এবং আমিল এ সবের জন্য দায়ী থাকতেন। এ ধরণের অনৈতিক আচরণকে বলা হতো বর-আমন্দ বা বর-আমন্দ-ই-আমিলান। এ ধরণের অনুশীলণ সম্রাট শাহজাহান (১৬২৮-১৬৫৮) এর সময় থেকে শুরু হয়ে সম্রাট মুহাম্মদ শাহের সময় (১৭১৯-১৭৪৮) পর্যন্ত চলেছে। সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বে কিছু প্রশাসনিক পরিবর্তন সাধিত হয় এবং তাঁর সময়ে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে আমিলকে পুলিশের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এ সময় থেকেই আমিলের কর্তৃত্ত্বাধীনে পুলিশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং তাঁকে ফৌজদার হিসেবেও গণ্য করা হতে থাকে। এভাবেই পরগণাসমূহের বিভিন্ন দলিলে একাধিক ফৌজদারের নাম পাওয়া যায়।  [নাসরীন আক্তার]

গ্রন্থপঞ্জি NA Siddiqui, Land Revenue Administration Under the Mughals (1700-1750), Bombay, 1970; JN Sarkar, Mughal Polity, Delhi, 1984; IH Qureshi, The Administration of the Mughal Empire, Karachi, 1966।