আমাশয়

আমাশয় (Dysentery) অন্ত্রে সংক্রমনের কারণে প্রদাহজনিত পেট ব্যাথা ও শ্লেষ্মা বা রক্তসহ পাতলা পায়খানা সৃষ্টিকারী রোগ। আমাশয় প্রধানত দুপ্রকার, অ্যামিবিয় আমাশয় বা অ্যামিবিয়াসিস আর ব্যাসিলারি আমাশয় বা শিগেলোসিস।

অ্যামিবীয় আমাশয় (Amoebic dysentery, Amoebiasis) Entamoeba histolytica নামক এককোষী পরজীবীঘটিত আমাশয়। এ এককোষী জীবাণু অন্ত্রের শ্লৈষ্মিক ঝিল্লি আক্রমণ করে এবং রোগ শুরু হলে শ্লৈষ্মিক ঝিল্লির স্থানে স্থানে ক্ষত সৃষ্টি হয় এবং সেগুলি থেকে শ্লেষ্মা, পচা দেহকোষ, অ্যামিবা-কোষ নির্গত হয়। রোগ লক্ষণে থাকে পেটব্যথা, ঘন ঘন শ্লেষ্মা সহকারে ঘন ঘন মলত্যাগ (দিনে ৩০ বার বা ততোধিক হতে পারে), মলত্যাগে যন্ত্রনা, বমি ও সাধারণ দৌর্বল্য। পেটে  একটি বিশেষ ধরণের (tenesmus) ব্যথা অনুভুত হতে দেখা যায়। নাভীর চারপাশে কামড়সহ মলত্যাগের তাড়াহুড়ো ইচ্ছে কিন্তু বাথরুমে গিয়ে মলত্যাগের অতৃপ্তি।  জীবাণুঘটিত রক্ত আমাশয়ে যেখানে মলের সঙ্গে টাটকা রক্তপাত ঘটে, সেখানে অ্যামিবীয় আমাশয়ে মারাত্মক পরিস্থিতি ব্যতীত সাধারণত মলে কোনো রক্ত থাকে না।

অ্যামিবা পরজীবী জীবনচক্রের এক পর্যায়ে মানুষের শরীরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গুটিকা (cyst) তৈরি করে। এগুলির পুরু প্রাচীর থাকে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির মলের সঙ্গে নির্গত হয়। নির্গত সিস্ট মাটিতে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে এবং সংক্রমণ ছড়ায়। তাই এ রোগবিস্তারের সঙ্গে মলত্যাগের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে। মল-নিকাশের সুব্যবস্থা নেই এমন স্থানে, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশের গ্রামাঞ্চলে যেখানে খোলা জায়গায় লোকে মলত্যাগ করে সেখানে এ রোগ অত্যধিক। সিস্টগুলি সাধারণত কাঁচা সবজি বা সালাদ থেকে অথবা ভালভাবে সিদ্ধ নয় এমন তরিতরকারির মাধ্যমে মানুষের অন্ত্রে প্রবেশ করে। কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে এ আমাশয় মাসের পর মাস স্থায়ী হতে পারে এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সংস্পর্শে পুনঃসংক্রমণের ফলেই এমনটি ঘটে। অন্ত্রের বাইরে অ্যামিবীয় আমাশয়ের সাধারণ প্রকাশ হলো অ্যামিবীয় হেপাটাইটিস বা যকৃতের প্রদাহ ও  জমা পূঁজ (abscess)।

অনগ্রসর আর্থ-সামাজিক অবস্থা, অনির্ভরযোগ্য মল-নিকাশ ব্যবস্থা এবং গ্রামাঞ্চলে উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে সারা বছরই এ আমাশয় প্রবল বিদ্যমান। এটি দেশের একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা। শিশুকালের প্রথম দিকেই রোগজীবাণু সংক্রমণ ঘটে এবং ১৫ বছর বয়সী কিশোরদের তিন-চতুর্থাংশে ইতোমধ্যেই কোনো এক সময় রোগ সংক্রমণ ঘটেছে সে লক্ষণ দেখা যায়, কেননা ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের রক্তে রোগজীবাণুর অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এসব উপসর্গহীন বাহক প্রায়শই অপুষ্টির কারণে পুরোপুরি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, অধিক শর্করা ও স্বল্প আমিষযুক্ত খাদ্যবস্ত্ত নির্ভরতা এ রোগের সহায়ক। বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশেই আমিষ ঘাটতিজনিত অপুষ্টি ব্যাপক। ফলে এক বিরাট সংখ্যক অপুষ্ট মানুষ অ্যামিবীয় আমাশয়ে আক্রান্ত হয়।

ব্যাসিলারি আমাশয় (Bacillary dysentery, Shigellosis)  Shigella  গোত্রিয় bacilli  কর্তৃক অন্ত্রে সৃষ্ট উদরাময়িক অসুস্থতা যা শিগেলোসিস নামেও পরিচিত। ব্যাসিলারি আমাশয়ের সংক্রমণ ঘটে দূষিত পানি বা খাদ্যের সঙ্গে Shigella ব্যাসিলাস গলাধঃকরণের ফলে। ব্যক্তিগত অপরিচ্ছন্নতা ও মলনিষ্কাশনের অব্যবস্থা এ রোগবিস্তারের সহায়ক। অন্ত্রের ভিতর Shigella ব্যাসিলাস দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং কোষকলার ক্ষতিসাধনের ফলে প্রদাহ, রক্তপাত ও জ্বরের সূচনা ঘটে এবং তীব্র পেটব্যথা অনুভূত হয়। মলে নির্গত শ্লেষ্মা ও রক্ত ব্যাসিলারি আমাশয়ের প্রধান লক্ষণ। পক্ষান্তরে অ্যামিবিক আমাশয়ে সাধারণত মলে রক্ত থাকে না এবং রোগও ততটা মারাত্মক নয়।

বাংলাদেশে ব্যাসিলারি ও পরজীবী উভয় প্রকার আমাশয়ই যথার্থ আঞ্চলিক রোগ বলে গণ্য এবং ব্যাসিলারি আমাশয়ে বিশেষত শিশুদের রুগ্নতা ও মৃত্যু হার যথেষ্ট ব্যাপক। প্রত্যেক বছর কোনো একটি কেন্দ্র থেকে ব্যাসিলারি আমাশয়ের ব্যাপক আক্রমণ ও দ্রুত বিস্তার ঘটে, পক্ষান্তরে পরজীবী আমাশয় ছড়ায় অনেকটা মন্থরভাবে।  [জিয়া উদ্দিন আহমেদ]

আরও দেখুন আইসিডিডিআর,বি