আবগারি শুল্ক

আবগারি শুল্ক  দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত দ্রব্যের ওপর আরোপিত কর। পরিভাষা হিসেবে ‘আবগারি কর’ ‘আবগারি শুল্ক’ অপেক্ষা ব্যাপকতর অর্থবহন করে এবং এর মধ্যে দ্রব্য বা সেবার উৎপাদন, বিক্রয়, বা ক্রয়ের ওপর আরোপিত কর অন্তর্ভুক্ত। তাত্ত্বিকভাবে, ‘আবগারি কর’ অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও আমদানির ওপর সমভাবে প্রযোজ্য হলেও বাস্তবে তা শুধু অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ওপর আরোপ করা হয়। আবগারি শুল্ক সরকারি রাজস্ব সংগ্রহের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, আবার এটি আয়ের পুনর্বণ্টনের উদ্দেশ্যেও ব্যবহৃত হতে পারে। করারোপের সুবিধার নীতি প্রয়োগের জন্যও আবগারি শুল্ককে ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন, কোনো বিশেষ দ্রব্যের (যথা, তামাকের) ওপর আবগারি শুল্ক সংগ্রহ করে উক্ত তহবিল ওই দ্রব্যের ভোগের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সহায়তার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। আবগারি শুল্ক তথাকথিত অনভিপ্রেত দ্রব্যাদির (যেমন, মদ ও তামাকের) ভোগকে নিরুৎসাহিত করতে আরোপ করা হয়। কখনও বা (যেমন যুদ্ধের সময়) কোনো কোনো দ্রব্যের দুষ্প্রাপ্যতা বা মূদ্রাস্ফীতির চাপে উক্ত দ্রব্যের ব্যবহার/ভোগ নিয়ন্ত্রণ বা হ্রাসের জন্য আবগারি শুল্ক আরোপ করা হয়। আবগারি শুল্ক মূল্যভিত্তিতে অথবা পরিমাণভিত্তিতে নির্ণয় করা হয়।

বহিঃশুল্ক, আবগারি ও বিক্রয় কর এ তিনটি প্রধান পরোক্ষ করের মধ্যে প্রাচীন ভারতবর্ষে (খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দের আগে) বাংলায় প্রথমে বহিঃশুল্ক চালু করা হয়। মুগল আমলে এ উপমহাদেশে একই ধরনের কর চুঙ্গি হিসেবে প্রচলিত ছিল। বিক্রয় কর প্রথম চালু করা হয় ১৯৩৮ সালে। আবগারি শুল্কের অনুরূপ লবণ কর মুসলিম শাসকরা চালু করে। সম্রাট আকবর লবণ কর বাতিল করার আদেশ দিলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে তা চালু ছিল। পারস্য থেকে মুসলিম অনুপ্রবেশকারীরা ভারতে আফিম নিয়ে আসে এবং আবগারি শুল্কের সমতুল্য আফিম কর মুসলিম শাসকদের রাজস্বের একটি প্রধান উৎস ছিল।

বাংলাদেশে বর্তমানে আবগারি শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪, আবগারি ও লবণ আইন-এর অধীনে। লবণ এবং দেশের সার্বভৌম এলাকায় উৎপাদিত বা প্রস্তুতকৃত দ্রব্যের ওপর শুল্ক আরোপ ও আদায় করার জন্য উক্ত আইন প্রবর্তন করা হয়। ১৯৯১ সালের জুলাইয়ে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) চালুর আগে আবগারি শুল্ক ছিল সরকারের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজস্ব-উৎস (মোট রাজস্বের প্রায় ২২%)। কিন্তু মূসকের মাধ্যমে আবগারি শুল্কের কর ভিত্তি সর্বনি¤œ পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়। ১৯৯১-৯২ সালে আবগারি শুল্কের আওতা পূর্ববর্তী বৎসরের ৯৯টি আইটেম (৯০টি দ্রব্য ও ৯টি সেবা) থেকে ২৫টি আইটেমে (২২টি দ্রব্য ও ৩টি সেবায়) হ্রাস করা হয়। এর ফলে আবগারি শুল্কের ৭৪.৭% কর-ভিত্তি মূসকের আওতায় হস্তান্তরিত হয়। ১৯৯০-৯১ সালে মোট করের ২৬.৫৩% ছিল আবগারি শুল্ক থেকে, যা ১৯৯১-৯২ সালে কমে হয় ১৭.৮%, ১৯৯২-৯৩ সালে ৩.৬৮%, ২০০০-০১ সালে ১.৩৯%, ২০১০-১১ সালে মাত্র ০.৩৫% এবং ২০২০-২১ সালে ১.০৮%।

সকল ধরনের উৎপাদিত মদের ওপর মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০-এর দ্বিতীয় তফসিলে নির্ধারিত হারে মাদক শুল্ক আরোপ করা হয়, তবে মাদকদ্রব্যের ওপর আবগারি শুল্ক বা মূসক আরোপ করা হয় না। ১৯৯১-৯২ সালে মূসক-এর আওতা বহির্ভুত যেসব দ্রব্য ও সেবার ওপর আবগারি শুল্ক আরোপযোগ্য ছিল, সেগুলি হলো তামাক, প্রাকৃতিক গ্যাস ও পেট্রোলজাত দ্রব্য, সংবাদপত্রের কাগজ, সোনা-রুপা ও সোনা-রূপার জিনিসপত্র, লবণ, ব্যাংক চেক এবং সাধারণ ইট। আবগারি ও লবণ আইনের ১৯৪৪-এর প্রথম তফসিলে তালিকাভুক্ত দ্রব্য ও সেবার ওপর আবগারি শুল্ক আরোপ করা হয়। ২০০৪ সালে প্রথম তফসিলের প্রথম অংশ বাতিল করা হয়, ফলে ২০০৪-০৫ সাল থেকে কোনো প্রচলিত দ্রব্যের উপর আর আবগারি শুল্ক প্রযোজ্য নয়। তবে ২০০৪ সালের প্রথম তফসিলের দ্বিতীয় অংশ অনুযায়ী কেবলমাত্র দুটো সেবার ক্ষেত্রে আবগারি শুল্ক আরোপ করা হয়। এগুলো হলো: ব্যাংকে ব্যক্তি সঞ্চয়ী হিসাবের উপর কর (৫০০০ টাকার জন্যে বাৎসরিক ১২০ টাকা) এবং অভ্যন্তরীণ রুটে বিমানের প্রতিটি সিঙ্গল টিকিটের উপর কর (বিদেশি কূটনীতিক ব্যতীত একজন যাত্রীর প্রতি যাত্রায় ২০০ টাকা করে কর)। আবগারি শুল্ক জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এর শুল্ক, আবগারি ও মূসক উইং কর্তৃক সংগৃহীত হয়।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকারের আবগারি শুল্ক আহরণের পরিমাণ ছিল ০.৪৬ বিলিয়ন টাকা যা মোট কর আহরণের শতকরা ০.০২ ভাগ। পরবর্তী ২০১৯-২০ অর্থবছরে কোভিড-১৯ অতিমারী সত্ত্বেও সরকারের আবগারি শুল্ক আহরণের পরিমাণ কিছুটা বেড়ে ০.৪৯ বিলিয়ন টাকায় দাঁড়ায় যা মোট রাজস্ব আয়ের শতকরা ০.০২ ভাগ। অতিমারী দীর্ঘায়িত হলেও ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারের আবগারি শুল্ক আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৩২.৭৭ বিলিয়ন টাকায় দাঁড়ায় যা মোট করের শতকরা ১.০৯ ভাগ ছিল। [স্বপন কুমার বালা]