আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি

আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি (International Oil Companies)  নিজ দেশের সীমানার বাইরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে নিয়োজিত কোম্পানিসমূহ। ইংরেজ শাসনামলে দক্ষিণ এশিয়ায় তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান প্রক্রিয়া শুরু হয়। ভারতের  আসাম রাজ্যের ডিগবয় জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত জয়পুর নামক স্থানে ১৮৬৬ সালে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে চারটি  কূপ খনন করা হয়। এর পূর্বে ১৮৮৩ সালে গঠিত আসাম রেলওয়েজ অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি তেল অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে কূপ খনন শুরু করে। পরবর্তী সময়ে আসাম ও তৎসংলগ্ন এলাকাসমূহে অনুসন্ধানকর্ম পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয় আসাম অয়েল কোম্পানি। বার্মা অয়েল কোম্পানি (বিওসি) নামে অন্য একটি কোম্পানি ১৮৯৬ সালে যাত্রা শুরু করে। বিওসি ১৮৯৭ সালে ইয়েনাংইয়াউং তেলক্ষেত্র এবং ১৯০১ সালে চাউক (সিংগু) তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়। এ দুটি তেলক্ষেত্রই বর্তমানের মায়ানমার অর্থাৎ বার্মাতে অবস্থিত ছিল। বিশ শতকের শুরুর দিকে ইন্দো-বার্মা অয়েল কোম্পানি তেল অনুসন্ধানের কাজ শুরু করে। এ সকল কোম্পানি ছাড়া আরও কয়েকটি কোম্পানি, যেমন টার্নার মরিসন অ্যান্ড কোম্পানি, হোয়াইট হল পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন, আসাম-বার্মা কোম্পানি এ অঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকর্ম পরিচালনা করে। ১৯১০ সালে আসাম অয়েল কোম্পানি বিওসি কর্তৃক অধিকৃত হয় এবং ১৯১০ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত বিওসি আসাম এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় ব্যাপক অনুসন্ধানকর্ম পরিচালনা করে। ১৯৩৭ সালে বিওসি, রয়েল ডাচ/শেল এবং অ্যাংলো ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি ভারতে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের অনুমতি লাভ করে এবং  ভূ-পদার্থবিজ্ঞান জরিপ শুরু করে। কিন্তু এ সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সকল প্রকার কর্মকান্ড স্থগিত হয়ে যায়।

বিশ্বযুদ্ধ শেষে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর ১৯৫০ সালের প্রথমভাগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পুনরায় ভূকম্পনীয় জরিপকার্য শুরু হয়। অবশ্য ইতোমধ্যে শেল অয়েল কোম্পানি পাকিস্তান শেল অয়েল কোম্পানিতে এবং বিওসি পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম লিমিটেড (পিপিএল)-এ রূপান্তরিত হয়। ভূকম্পনীয় জরিপকার্যে পাকিস্তান শেল অয়েল কোম্পানি এবং পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম লিমিটেড-এর সঙ্গে স্ট্যান্ডার্ড ভ্যাকুয়াম অয়েল কোম্পানিও যোগ দিয়েছিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর শেল তাদের কর্মকান্ড গুটিয়ে নেয় এবং পিপিএল তাদের ক্ষেত্রসমূহ পরিত্যাগ করে। বাংলাদেশ সরকার পিপিএল-এর সম্পদসমূহ অধিগ্রহণ করে এবং সেসঙ্গে শেল কোম্পানির সম্পদসমূহও কিনে নেয়। ১৯৭০-এর প্রথমভাগে তৎকালীন সরকার বিভিন্ন বিদেশি তেল কোম্পানি, যেমন আটলান্টিক রিচফিল্ড কোম্পানি, ইউনিয়ন অয়েল অব ক্যালিফোর্নিয়া (ইউনোকল), অ্যাশল্যান্ড অয়েল, কানাডিয়ান সুপিরিয়র, ইনা-নাফটাপলিন এবং জাপান অয়েল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন-এর সঙ্গে দেশের উপকূলীয় এলাকায় তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য পিসিসি (Petroleum Concession Contracts) চুক্তি স্বাক্ষর করে। উপকূলীয় অনুসন্ধানের ফলাফল হিসেবে ইউনোকল কর্তৃক একটি মাত্র  গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলি তাদের সফলতার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে ১৯৭৮ সালের মধ্যে সকলেই চুক্তি পরিত্যাগ করে চলে যায়। ১৯৮০ সালের প্রথমভাগে শেল কোম্পানি পুনরায় ফিরে আসে এবং উপকূলের নিকটবর্তী এলাকায় দুটি কূপ খনন করে। দুর্ভাগ্যবশত খননকৃত দুটি কূপই শুষ্ক হওয়ায় শেল আবারও চলে যায়।

১৯৯০ সালে বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের অক্সিডেন্টাল অয়েল, অকল্যান্ড অয়েল ও ইউনাইটেড মেরিডিয়ান কর্পোরেশন এবং যুক্তরাজ্যের কেয়ার্ন এনার্জি-এর সঙ্গে  হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানের লক্ষ্যে উৎপাদন-অংশীদারি চুক্তি (Production Sharing Contract – PSC) স্বাক্ষর করে। ১৯৯৭ সালে সরকার আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলির কাছ থেকে দরপত্র আহবান করে চমৎকার সাড়া লাভ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ হাইড্রোকার্বনের সম্ভাব্য মজুত রয়েছে যা কেবল উন্নত প্রযুক্তি এবং প্রয়োজনীয় অর্থের স্বল্পতার কারণে কাজে লাগানো সম্ভবপর হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলির অনুসন্ধানের ফলাফল হিসেবে কেয়ার্ন এনার্জি কর্তৃক উপকূলীয় সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র এবং অক্সিডেন্টাল কর্তৃক বিবিয়ানা ও মৌলভীবাজার গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে কেয়ার্ন-এর সমস্ত দায়দায়িত্ব শেল এবং অক্সিডেন্টালের সমস্ত দায়দায়িত্ব ইউনোকল গ্রহণ করে।

১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় পর্যায়ের দরপত্রের ফলাফল হিসেবে ৭ নম্বর ব্লকের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইউনোকল কর্পোরেশনের সঙ্গে এবং ৫ নম্বর ও ১০ নম্বর ব্লকের জন্য শেল-কেয়ার্ন এর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের উৎপাদন-অংশীদারি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। উভয় চুক্তিই ২০০০ সাল থেকে কার্যকর হয় এবং এক্ষেত্রে চুক্তির শর্তানুসারে ক্যারিড ইন্টারেস্ট ব্যবস্থার (Carried Interest System) আওতায় ১০ শতাংশ ইকুইটিসহ দেশিয় কোম্পানি  বাপেক্সও একটি অংশীদার। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সর্বশেষ দ্রবপত্রটি আহবান করা হয়। এতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘কোনকো ফিলিপ্র’ এবং আয়ারল্যান্ডের ‘তাল্লো অয়েল’  বঙ্গোপসাগরে ৯টি ব্লক অনুসন্ধানের জন্য দেয়া হয়েছে, ‘কোনকো’ ফিলিপ্স’ কে দেয়া হয়েছে ৮টি গভীর পানিবিশিষ্ট ব্লক আর ‘তাল্লো অয়েল’ কে দেয়া হয়েছে অগভীর পানিবিশিষ্ট একটি ব্লক।

বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে মোট ২৮টি ব্লকের জন্য দরপত্র আহবান করেছিল যার ২০টি গভীর এবং ৮টি অগভীর। ১০টি গভীর পানিবিশষ্ট ব্লকের জন্য আর ৩ টি অগভীর পানিবিশিষ্ট ব্লকের জন্য মোট ৭টি কোম্পানির কাছ থেকে দরপত্র জমা পড়েছে। অন্যান্য কোম্পানিগুলি হলো অস্ট্রেলিয়ার ‘‘সানতো’জ’’ (Santo's) চায়নার ‘সি.এন.ও.ও.সি (CNOOC) ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড,’ কোরিয়া ‘ন্যাশনাল অয়েল করপোরেশন’ এবং অপেক্ষাকৃত স্বল্পপরিচিত কোম্পানিসমূহ যেমন ‘লংউড’স্ (Longwood's) রিসোর্স লিমিটেড’ এবং ‘‘কমট্রাক সার্ভিসেস লিমিটেড’’।

পেট্রোবাংলা ২০০৮ সালের মধ্যেই কোম্পানিগুলির সাথে চূড়ান্ত উৎপাদন চুক্তি স্বাক্ষরে আশাবাদী। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশের ৯টি ব্লকের অনুসন্ধানকার্য পরিচালনার নিমিত্তে ‘কোনকো ফিলিপ্স’ বিনিয়োগ করবে ৪৫ মিলিয়ন ডলার এবং তাল্লো অয়েল বিনিয়োগ করবে ৫০ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য গ্যাসক্ষেত্রসমূহ হতে প্রতিদিন প্রায় ১.৬ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এবং ৫,৫০০ ব্যারেল কনডেনসেট উত্তোলন করে থাকে। মোট পাঁচটি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি বর্তমানে সক্রিয়। এগুলি হলো শেভরন, কেয়ার্ন এলার্জি, তাল্লো অয়েল, নাইকো রিসোর্সেস এবং টোটাল।  [মীর মঈনুল হক ও সানজিদা মূর্শেদ]