আজরফ, দেওয়ান মোহাম্মদ

আজরফ, দেওয়ান মোহাম্মদ (১৯০৮-১৯৯৯)  শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, লেখক, জাতীয় অধ্যপক। ১৯০৮ সালের ১ জানুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার তেঘরিয়া গ্রামে মাতামহ হাসন রাজার বাড়িতে তাঁর জন্ম। দুহালিয়ার মধ্য ইংরেজি স্কুলে তিনি পড়াশোনা করেন। ছাত্রজীবনে প্রতিটি পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি ১৯৩০ সালে সিলেটের মুরারি চাঁদ কলেজ থেকে ডিস্টিংকশনসহ বি এ পাস করেন এবং ১৯৩২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন।

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ

১৯৪৮ সালে সুনামগঞ্জ কলেজের যুক্তিবিদ্যার প্রভাষক পদে যোগ দিয়ে মোহাম্মদ আজরফ শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন এবং ১৯৫৪ সালে এই কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরে তিনি বিভিন্ন কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি আবুজর গিফারি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে খন্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগে যোগদান করেন এবং আসাম প্রাদেশিক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি  মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সমর্থক ছিলেন। ১৯৪৬ সালে আসামে বহিরাগত মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে এবং ১৪৪ ধারা অমান্য করার কারণে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং তিনি শিলচরে দশ মাস কারাদন্ড ভোগ করেন।

মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন ভাষা আন্দোলনের একজন দৃঢ় সমর্থক। ১৯৪৮ সালে নও বেলাল পত্রিকার সম্পাদক থাকাকালে তিনি উক্ত পত্রিকায় ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে লেখা শুরু করলে  উর্দু ভাষার সমর্থকরা তাঁর জীবননাশের হুমকি দেয়। একই কারণে তাঁকে ১৯৫৪ সালে সুনামগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে অপসারণ করা হয়। তিনি ১৯৪৯ সালে তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং আজীবন ওই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন।

সাহিত্য, সংস্কৃতি ও দর্শন সম্পর্কে মোহাম্মদ আজরফের সমধিক আগ্রহ ছিল। তিনি ১৯৩৬ সালে সিলেটে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ গঠন করেন এবং ১৯৪০ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশে দর্শন চর্চার ক্ষেত্রেও তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। তিনি ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত বাংলাদেশ দর্শন সমিতির সভাপতি ছিলেন। তিনি পাকিস্তান দর্শন কংগ্রেসেরও একজন সক্রিয় সদস্য এবং কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। একজন বিশিষ্ট দার্শনিক এবং ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবে তিনি পাকিস্তান, ভারত, ইরাক, দক্ষিণ কোরিয়া, রোম প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক প্রবন্ধ পাঠ করে প্রশংসা অর্জন করেন।

সাহিত্য, দর্শন, সমাজ, সংস্কৃতি বিষয়ে মোহাম্মদ আজরফের প্রায় ৬০টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এবং প্রায় ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ অপ্রকাশিত রয়েছে। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে তমদ্দুনের বিকাশ, ইসলাম ও মানবতাবাদ, মরমী কবি হাসন রাজা, ধর্ম ও দর্শন  ইত্যাদি।

জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অসাধারণ অবদানের জন্য মোহাম্মদ আজরফ স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, আন্তর্জাতিক মুসলিম সংহতি পুরস্কার, একুশে পদক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার, শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার, বাংলাদেশ মুসলিম মিশন পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৩ সালের ৪ নভেম্বর তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক পদ প্রদান করে। ১৯৯৯ সালের ১ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।  [প্রদীপ কুমার রায়]