আইন প্রণয়ন

আইন প্রণয়ন  সংসদের মাধ্যমে আইন প্রণয়নের বিষয়টি ১৭৭৩ সাল পর্যন্ত এদেশের মানুষের কাছে অপরিচিত ছিল। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট  ১৭৭৩ সালে গভর্নর জেনারেল-ইন-কাউন্সিলকে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা এবং ১৮৮৩ সাল থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের পদ্ধতি অনুসরণ করে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করে। ১৮৬১ সাল থেকে  শুরু করে ১৯৪৭ সালে ভারতে ব্রিটিশ শাসন অবসানের  পূর্ব পর্যন্ত কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক আইন পরিষদ যথাক্রমে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক বিষয়ে আইন প্রণয়ন করে আসছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত শাসনতন্ত্রের অধীনে  নির্বাচিত সংসদ আইন পাশ করত। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র বলবৎ হবার পর আইন প্রণয়নের জন্য ভোটের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ নির্বাচিত হয়। প্রায় সব বিল উত্থাপন করে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। খুব অল্পসংখ্যক বেসরকারি সদস্যের বিল সংসদীয় বিধিবিধান অনুযায়ী সংসদের কোনো সদস্য দ্বারা উত্থাপন করা হয়। সাধারণত সংশিষ্ট মন্ত্রণালয় নীতিনির্দেশনা সংক্রান্ত নথিপত্র তৈরি করে এবং একটি প্রাথমিক বিলের খসড়া তৈরি করে সারাংশসহ বিলের খসড়া ক্যাবিনেট মিটিংয়ে অনুমোদনের জন্য ক্যাবিনেট ডিভিশনে প্রেরণ করা হয়। ক্যাবিনেটের অনুমোদনের পর যে মন্ত্রণালয় এ বিল উত্থাপন করেছে সেই মন্ত্রনালয়কে বিলের চুড়ান্ত খসড়া তৈরি করার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং ক্যাবিনেট তা বিবেচনা করে দেখেন। তারপর আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় উদ্যোক্তা মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে হয় একটা চূড়ান্ত খসড়া বিল তৈরি করবে নয়ত খসড়া বিলটি পুঙ্খানুপুঙ্খ খতিয়ে দেখবে। তারপর চূড়ান্ত খসড়া বিল অথবা খতিয়ে দেখা বিল উদ্যোক্তা মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো হয় এবং অনুমোদন প্রাপ্তির পর এটাকে সংসদ সচিবালয়ে পাঠানো হয়। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ড্রাফট বিল পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য ল’কমিশনে পাঠাতে পারে এবং কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিলটি কমিশনের পরামর্শ অনুযায়ী পরিমার্জন করা হয়। এ বিলটি উদ্দ্যোক্তা মন্ত্রণালয়ের নিকট পাঠানোর আগে এ কাজ সম্পন্ন করা হয়। কোনো অর্থ বিল (কর ধার্যের প্রস্তাব, সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় অথবা অন্যান্য আর্থিক বিষয়) রাষ্ট্রপতির অনমোদন ব্যতিরেকে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা যায় না। মহামান্য রাষ্ট্রপতির সুপারিশের পর স্পীকার বিলটিকে সংসদে উপস্থাপনের জন্য তারিখ নির্ধারণ করেন। বিলটি সংসদে উপস্থাপনের পূর্বে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী সংসদ-সদস্যদের ওই বিলের কপি প্রদান করেন। বিল উপস্থাপনকে ফার্স্ট রিডিং বলা হয়। তারপর এ বিলটির উপর বিশদ আলোচনার জন্য আরেকটি তারিখ ধার্য্য করা হয় যাকে বিলের সেকেন্ড রিডিং বলে অভিহিত করা হয়। এ পর্যায়ে বিলের উপর আলোচনা হতে পারে অথবা একটি স্থায়ী কমিটি অথবা বাছাই কমিটির কাছে পাঠানো অথবা জনমত যাচাইয়ের জন্য প্রচার করা যেতে পারে। কমিটি রিপোর্টসহ বিলটিকে সংসদে পাঠাবে। এরকম রিপোর্টসহ বিলটি বিবেচনার জন্য রাখা হয়। বিলটি গৃহীত হলে স্পীকার ভোটের জন্য সংসদে পেশ করেন। বিলটিতে যদি কোনো সংশোধনী আনার প্রস্তাব করা হয় এবং ভোটে দেওয়া হয় তখন সংশোধিত বিলটি সংসদে বিবেচনার জন্য পেশ করা হয়। সেকেন্ড রিডিংয়ের পর যদি কোনো বিল পাশ হয় তাহলে একে থার্ড রিডিং বলা হয়। কোনো বিল পাশ হতে হলে উপস্থিত সংসদ-সদস্যদের অধিকাংশের ভোটের প্রয়োজন। বিল পাস হওয়ার পর স্পীকার এতে স্বাক্ষর দান করেন। এরপর বিলটি রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠানো হয়। রাষ্ট্রপতির সম্মতির পর বিলটি জাতীয় সংসদের একটি আইন হিসেবে সরকারি গেজেটে ছাপা হয়।

যখন জাতীয় সংসদের অধিবেশন থাকে না অথবা সংসদ ভেঙে দেয়া হয়, রাষ্ট্রপতির যদি প্রতীয়মান হয় যে এমন একটা অবস্থা বিরাজ করছে যার জন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কোনো অধ্যাদেশ জারী করতে পারেন যা সরকারি গেজেটে মুদ্রিত হয়। এ অধ্যাদেশের আইনের সমপরিমাণ ক্ষমতা থাকে। কিন্তু এ অধ্যাদেশ শাসনতন্ত্রের পরিপন্থী হতে পারে না। জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের ত্রিশ দিনের মধ্যে যদি এ অধ্যাদেশ অনুমোদিত না হয় সেক্ষেত্রে ত্রিশ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর অধ্যাদেশের কোনো কার্যকারিতা থাকে না। এধরনের সমাদিষ্ট আইনকে রুল অথবা রেগুলেশন অথবা অর্ডার বলা হয়। এধরনের রুল, রেগুলেশন বা অর্ডার মূল আইন অথবা অধ্যাদেশের পরিপন্থী হতে পারেনা। অনুরূপভাবে জাতীয় সংসদ কর্তৃক পাশকৃত কোনো অধ্যাদেশ অথবা আইন শাসনতন্ত্রের পরিপন্থী হতে পারে না।

সমাদিষ্ট বা উপ-আইনকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়, বিধি, প্রবিধি ও আদেশ। মন্ত্রণালয় কর্তৃক তৈরি সমাদিষ্ট আইনকে রুল বলা হয়। রেগুলেশন তৈরি করে বিধিবদ্ধ স্বায়ত্বশাসিত কর্তৃপক্ষ। প্রশাসনিক সংস্থা এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তৈরি করে অর্ডার। সংশ্লিষ্ট বিভাগ অথবা অপর কর্তৃপক্ষ সমাদিষ্ট আইনের প্রাথমিক খসড়া তৈরি করে। তারপর অনুমোদনের জন্য নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। অনুমোদনের পর খসড়াটি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ড্রাফটিং বিশেষজ্ঞের পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। খসড়াটি চূড়ান্ত হলে যে মন্ত্রণালয় তা পাঠিয়েছিল সেখানে এর পরীক্ষা এবং চুড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। এধরনের অনুমোদনের পর চূড়ান্ত খসড়া রুল বা রেগুলেশন সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়। এধরনের প্রকাশনা ব্যতীত কোনো রুল অথবা রেগুলেশন কার্যকর হতে পারে না।

[কাজী এবাদুল হক]