অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান

অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতীয় সমাজে একটি সম্পূর্ণ পৃথক বৈশিষ্ট্যের বর্ণ বা জনগোষ্ঠী। সতেরো ও আঠারো শতকে যেসব ইংরেজ বণিক ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ভারতে আসে, ব্রিটেনে ফিরে যাবার পর তাদের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান নামে অভিহিত করা হতো। এদেরকে ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান’ও বলা হতো এবং খুব ধনীদের বলা হতো ‘নবাব’। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ‘ইন্ডিয়ান’ বা ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান‘দের গড়ে তোলা শক্তিশালী লবি এবং ব্রিটিশ সমাজে ‘নবাব’দের প্রাধান্যের উল্লেখ দেখা যায় আঠারো শতকের ইংরেজি সাহিত্যে। কিন্তু ভারতের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা ছিল সম্পূর্ণ পৃথক বৈশিষ্ট্যের নব্য সামাজিক শ্রেণি। এরা ছিল ব্রিটিশ পিতা ও ভারতীয় মাতার সন্তান। স্থানীয় বাঙালিরা সংকরজাত এ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের ‘বর্ণসংকর’ রূপে অবজ্ঞা করত এবং এদের সঙ্গে সকল প্রকার সামাজিক সম্পর্ক পরিহার করত।

ইতিহাসে দেখা যায় যে, স্পেনীয় বা পর্তুগীজ, ব্রিটিশ বা মুগল সকল বিদেশি শাসনামলে এ বিদেশিরা যে দেশেই বসতি স্থাপন করেছে সেখানে প্রায় অপরিহার্যভাবেই সৃষ্টি করেছে এ মিশ্র ধরনের সম্প্রদায়। বাংলায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটে নি। উনিশ শতকের প্রথমদিকের পূর্ব পর্যন্ত ব্রিটিশ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও ভাগ্যান্বেষী অভিযাত্রিদের খুব কমসংখ্যকই বাংলায় বসবাসের জন্য তাদের পরিবার পরিজন সঙ্গে নিয়ে আসতেন। বাংলায় তাদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করার জন্য এদের অনেকের মধ্যেই রক্ষিতা ও দাসী রাখার প্রবণতা দেখা যায়। এদের কিছুসংখ্যক এদেশীয় মহিলাদের বিয়েও করে। উনিশ শতকের শেষের দিকে এদের সন্তান-সন্ততিরা বেশ বড় আকারের একটা সম্প্রদায় গড়ে তোলে। এসব সন্তানদের বিশেষত বৈধ সন্তানদের বড় একটা অংশকে শিক্ষার জন্য ব্রিটেনে পাঠানো হতো। ব্রিটিশ সমাজে তাদের অবনমিত অবস্থার কারণে বাধ্য হয়ে তারা চাকরির সন্ধানে নিজেদের জন্মভূমিতে ফিরে আসে। প্রধানত রেলওয়ে, স্টিমার সার্ভিস, ডাক বিভাগ এবং নিম্নস্তরের সরকারি পদেই এ বর্ণসংকররা বেশিরভাগ চাকরি লাভ করে। পরে তারা পাট ব্যবসাসহ নানা ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্যিক সংস্থায় যোগ দেয়।

বিশ শতকের প্রথম দশকের পূর্বপর্যন্ত এ সংকর সম্প্রদায়ের কোনো আইনগত বা সামাজিক  অভিধা ছিল না। তারা বর্ণসংকর, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান, ইন্দো-ব্রিটন ইত্যাদি নামে পরিচিত হতো। ১৯১১ সালের পূর্বেকার আদমশুমারিতে তাদের ইউরেশিয়ান হিসেবে গণ্য করা হয়। ইউরেশিয়ান বলতে কেবল সংকর সম্প্রদায়কেই নয়, ইউরোপীয়, মধ্যএশীয় এবং অন্যান্য এশীয় দেশের নাগরিকদেরও বোঝাত। ১৯১১ সালের আদমশুমারিতে ভারত ও বাংলা সরকার প্রথম সরকারিভাবে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পরিচয়ের উল্লেখ করেন। এ আদমশুমারি অনুসারে ভারতীয় মাতা ও ব্রিটিশ পিতার সন্তান এবং যেকোন অবস্থায় বাংলায় বসবাসরত সকল ইউরোপীয়কে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরূপে চিহ্নিত করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

১৯২১ সালে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সংখ্যায় মাত্র ২৫ হাজার হলেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই এরা ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী। ২৫০ সদস্যের আইন পরিষদে (১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায়) ২৫ জন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সদস্যের উপস্থিতি থেকেই এ সম্প্রদায়ের প্রভাব অনুধাবন করা যায়। এমনকি ১৯৩৫ সালের সংবিধানেও তাদের জন্য আইনসভার ৪টি আসন সংরক্ষিত ছিল।  [সিরাজুল ইসলাম]