হালদার, অসিতকুমার

হিালদার, অসিতকুমার (১৮৯০-১৯৬৪)  চিত্রশিল্পি। প্রগতিশীল পরিবারের সদস্য অসিতকুমার হালদারের জন্ম কলকাতায়। চিত্রশিল্পি হওয়ার জন্য তাঁর সময়ের অন্যান্যদের মতো তাঁকে নিজ পরিবারের বিরুদ্ধাচরণ করতে হয় নি, বরং তিনি তাঁর পিতা ও পিতামহের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন। ১৯০৪ সালে ১৪ বছর বয়সে তিনি কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। ভাস্কর হিসেবে ১৯০৫ সালে হালদার বাংলার দুজন বিখ্যাত শিল্পির কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। এরা হলেন কৃষ্ণনগরের যদু পাল ও বাকেশ্বর পাল। পরবর্তীকালে লিওনার্ড জেনিংস-এর কাছে তিনি প্রশিক্ষণ নেন।

অসিতকুমার হালদার শান্তিনিকেতনে কলাভবন প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথকে যথেষ্ট সহায়তা করেন। ১৯১১ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত তিনি কলাভবনের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বিকাশে রবীন্দ্রনাথকে সহযোগিতা করেন। শান্তিনিকেতনে সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে ধর্মীয় আলপনা নকশাকে তিনি অলঙ্করণের একটি মাধ্যম হিসেবে সূচিত করেন। এ সময়েই তিনি তাঁর ধ্যান-ধারণা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন এবং মুকুলচন্দ্র দে, রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেববর্মণ, বিনোদবিহারী মুখার্জি ও আরও কয়েকজন প্রতিভাবান ছাত্রকে অনুপ্রাণিত করেন। পরবর্তীকালে ১৯২৪ সালে তিনি জয়পুরে মহারাজার আর্ট স্কুলে প্রধান অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্প আন্দোলন সাফল্যমন্ডিত হয়ে ওঠে অসিতকুমার হালদার,  নন্দলাল বসু ও সুরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলির মতো কিছু তরুণ ও প্রতিভাবান শিল্পির সহযোগিতায়। হালদার অবশ্য তাঁর শৈলী ও চিন্তা চেতনায় অন্যান্যদের থেকে স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন। প্রকৃত অর্থেই তাঁর সহকারীদের তুলনায় কাজের ধরনে তিনি ছিলেন আলাদা। ১৯০৯ থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে তিনি তাঁর অঙ্কন স্টাইল অক্ষুণ্ণ রেখে বিখ্যাত অজন্তা, বাগ্ ও যোগীমারা গুহাচিত্রের অনুলেখ্য প্রণয়ন করেন।

১৯২৩ সালে বিদেশ ভ্রমণকালে হালদার উপলব্ধি করেন যে, বাস্তবধর্মী চিত্রাঙ্কনে ইউরোপীয় পদ্ধতি সীমার গন্ডিতে বন্দি। এ কারণেই তিনি তাঁর চিত্রে এ বন্ধন ছিন্ন করার চেষ্টা করেন। তাঁর চিত্রকর্মে অবকাঠামো তৈরি হয়েছে বিষয়বস্ত্তর গুরুত্ব অনুযায়ী। তিনি বিষয়বস্ত্তর পেছনে তাঁর চিন্তা-চেতনাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। হালদারের অঙ্কিত যশোদা ও কৃষ্ণ শুধুই ধর্মীয় চিত্র ছিল না। এটি ছিল কৃষ্ণের অসীমতার সঙ্গে যশোদার সসীম ভুবনের সম্পৃক্ত উপস্থাপনা। হালদার বুদ্ধের জীবনের ওপর ৩২টি ছবি অাঁকেন। তিনি ভারতীয় ইতিহাসের ওপরও ৩০টি ছবি অঙ্কন করেন। এগুলিতে শুধু ঘটনা বিধৃত হয় নি, বরং যুক্ত হয়েছে ইতিহাসের মূল্যবোধ ও চিন্তা-চেতনা।

হালদারের বিখ্যাত চিত্রকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো যশোদা ও কৃষ্ণ, অ্যাওকেনিং অব মাদার ইন্ডিয়া, রায়-রাজা, পদ্ম, বীণা, কুণাল ও অশোক, দান-লীলা, রাসলীলা, অগ্নিময়ী সরস্বতী, প্রণাম, দ্য প্রেশাস গিফ্ট, দ্য ক্যাপটিভ প্রিন্স, দ্য ক্যারেস, দ্য নিগ্রো প্রিন্সেস ইত্যাদি।

হালদারের অসাধারণ শৈল্পিক প্রতিভার জন্যই ব্রিটিশ সরকার তাঁকে লাক্ষ্ণৌ-এর গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্ট অ্যান্ড ক্রাফ্টস-এর অধ্যক্ষ নিযুক্ত করে। তিনিই ছিলেন ব্রিটিশ ভারতে গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ। অসিতকুমার হালদার ১৯৩৪ সালে লন্ডনের রয়েল সোসাইটি অব আর্ট-এর প্রথম ভারতীয় ফেলো হিসেবেও নির্বাচিত হন। ১৯৩৮ সালে এলাহাবাদ মিউজিয়ামে তাঁর চিত্রকর্ম সম্বলিত ‘হালদার হল’ নামে একটি গ্যালারি উম্মুক্ত করা হয়। ১৯৬৪ সালে অসিতকুমার হালদার এর মৃত্যু হয়।  [সীমা রায় চৌধুরী]