হাওলা স্বত্ব

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২৩:১৬, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

হাওলা স্বত্ব ঊনবিংশ শতাব্দীতে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় কৃষি জমির মালিকানা সম্পর্কের ক্ষেত্রে সৃষ্ট মধ্যস্বত্ব। মধ্যস্বত্বের উৎপত্তি তথা জমিদার এবং ভূমি চাষকারী রায়ত বা প্রজার মধ্যভাগী হিসেবে গড়ে ওঠা মধ্যস্বত্ব সমস্যা ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রত্যক্ষ ফল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর জমিদারদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল রাজস্ব বিক্রয় আইন বা সূর্যাস্ত আইন। এই আইনের অধীনে যে সকল স্বত্বাধিকারী বা জমিদার তাদের ভূমির রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থ হতো, তাদের ভূমি সরকারি রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে  প্রকাশ্য নিলামে বিক্রয় করা হতো। এই আইনের অধীনে নিলামে অসংখ্য জমিদারি বিক্রয় হয়ে যায়। এই সঙ্কট মোকাবেলার জন্য বঙ্গদেশের জমিদারগণ তাদের এবং প্রকৃত ভূমিচাষিদের মধ্যে নানা ধরনের মধ্যস্বত্ব সৃষ্টি করেন। হাওলা ভূমিস্বত্ব এগুলির অন্যতম।

হাওলা ভূমিস্বত্ব ছিল মূলত বাকেরগঞ্জ জেলা ও তার আশেপাশে বনভুমি আবাদ প্রক্রিয়ার ফল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সুন্দরবন অঞ্চলে হাওলাদার নামে পরিচিত হাওলা ভূমিস্বত্ব গ্রহণকারীরা বিস্তীর্ণ এলাকার জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষাবাদ শুরু করে। নতুন আয়ের উৎস সন্ধানে সুন্দরবনাঞ্চল সন্নিহিত এলাকার জমিদারগণ আশেপাশের জঙ্গল পরিষ্কার করে দখল নেওয়ার জন্য কৃষি ইজারাদার বা কৃষকদের উৎসাহিত করতেন এবং আকর্ষণীয় শর্ত প্রস্তাব করতেন। জঙ্গল পরিষ্কার করে জমি চাষযোগ্য করতে কৃষকদের অনেক মূলধন বিনিয়োগ করতে হতো। আবাদ করা জমিতে নামমাত্র খাজনা প্রদানের বিনিময়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অথবা চিরস্থায়ী ভিত্তিতে স্বত্ব লাভ করাই তাদের জমি আবাদে উদ্বুদ্ধ করত। নিজ মূলধন, শ্রম ও সংগঠন খাটিয়ে জঙ্গল আবাদে সম্মত কৃষকদের নিকট হাওলা নামের বৃহদায়তন ভূমিখন্ড বন্দোবস্ত দেওয়া হতো। তারা বন ভূমি আবাদ প্রচেষ্টায় এ কারণে আকৃষ্ট হতো যে, অতিসামান্য বা নামমাত্র খাজনার বিনিময়ে তারা জমির নিরাপদ স্বত্ব লাভ করতে পারত। প্রান্তিক হিসাবে হাওলাদারগণ তাদের অধীনে ‘নিম’ বা দ্বিতীয় স্তরের হাওলাদার স্বত্ব সৃষ্টি করে তাদের অধিকার সম্প্রসারণ করে। ‘নিম’ হাওলাদারগণ তাদের অধীনে পর্যায়ক্রমে আবার ‘ওসাত নিম’ হাওলাদার বা তৃতীয় স্তরের হাওলাদার সৃষ্টি করে। এভাবে ‘হাওলা’ শব্দ যোগ করে পাঁচ থেকে দশ স্তর পর্যন্ত একের পর এক স্বত্ব সৃষ্টি করা হয়েছিল। বাকেরগঞ্জ জেলাকে কেন্দ্র করে বাংলার উপকূলীয় জেলাসমূহে বিভিন্ন স্তরবিশিষ্ট হাওলাদার সম্প্রদায়ের এভাবেই উৎপত্তি ঘটেছিল।

কিন্তু এসব ভূমিস্বত্ব সৃষ্টি করা হয়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত রেগুলেশনের চাপ থেকে রেহাই পাবার জন্য। হাওলাদারদের মধ্যে গড়ে ওঠা সামাজিক সংহতির স্বীকৃতিস্বরূপ ১৮৩৭, ১৮৪১ ও ১৮৪৫ সালে আইন প্রণয়ন করে সরকার তাদের হাওলা স্বত্বের স্বীকৃতি দান করে। এই আইনসমূহে সকল প্রকার হাওলা ভূমিস্বত্ব বৈধ ঘোষণা করা হয়। সবশেষে ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনে সকল স্তরের ভূমিস্বত্ব সংক্রান্ত রীতিনীতি ও বিধিবিধানসমূহ আইনে পরিণত করা হয় এবং সকল প্রকারের হাওলা ভূমিস্বত্বের অধিকার ও দায়দায়িত্ব সংজ্ঞায়িত করা হয়। ১৯৫০ সালের পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনে হাওলা ভূমিস্বত্ব বিলোপ করা হয়।  [সিরাজুল ইসলাম]