হকার

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৮:৫৮, ২৫ মার্চ ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

হকার (Hawkers)  ফেরিওয়ালা; নগর ও গ্রামাঞ্চলের ক্ষুদে ব্যবসায়ী। হকাররা বাড়ি বাড়ি ঘুরে অথবা অন্যান্য জনসমাগমে পণ্য ও সেবা ফেরি করে। এরা এক ধরনের ভাসমান বণিক এবং এটি দেশের একটি সনাতন ও ঐতিহ্যবাহী পেশা। ব্যাপক অর্থে হকার বলতে কতিপয় ক্ষুদ্র পেশাজীবী, যেমন: হাতুড়ে ডাক্তার; নাপিত, সাইকেল ও রিকশা মেরামতকারী, পিঠা বিক্রেতা, বিভিন্ন ধরনের হাল্কা খাবার বিক্রেতা, ফল বিক্রেতা প্রভৃতি শ্রেণীকেও অন্তর্ভুক্ত করে। হকারদের বেশিরভাগই কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানে অস্থায়ী ভিত্তিতে তাদের পণ্যসামগ্রী বিক্রয় ও সেবাকর্ম প্রদান করে। এরা খুবই অল্প পুঁজি নিয়ে ব্যবসা করে। অধিকাংশ হকারের মূলধন এক হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। নির্দিষ্ট স্থানে পণ্য বিক্রয়কারী হকারদের প্রধান খরিদ্দার হচ্ছে শহর ও নগরের স্বল্প আয়ের লোকজন। ভাসমান হকাররা বাড়ি বাড়ি পণ্য ফেরি করার সুবাদে তারা মধ্যম ও স্বল্প উভয় আয়ের জনগোষ্ঠীর কাছেই পৌঁছতে সক্ষম হয়।

ভাসমান হকার

বাংলাদেশে নগরের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু এই বর্ধিষ্ণু জনগণের সবার পক্ষে কর্মসংস্থানে নিয়োজিত হওয়া সম্ভবপর হয় না। শহরে আসা নতুন জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই শহরের বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো দ্বারা অবশোষিত হতে ব্যর্থ হয়। ফলে এই জনস্রোত নগরীর ব্যাপক বিস্তৃত অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রসমূহে নিয়োজিত হয়ে পড়ে। এভাবে বাংলাদেশের নগর কেন্দ্রসমূহের জনগণের একটি বিরাট অংশ রাস্তাঘাট ও ফুটপাতে পণ্য ফেরি করার মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নিজেদের নিয়োজিত রাখছে। হকারদের ব্যবসাকর্ম পরিচালনার ধরনের ওপর তাদের কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়, যেমন: ভাসমান হকার (mobile hawkers), আধা-স্থায়ী হকার (semi static hawker) এবং স্থায়ী হকার (static hawkers)। ভাসমান হকাররা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পণ্য ফেরি করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের কাঁধে অথবা মাথায় পণ্য বহন করে, আবার কেউ কেউ বিশেষ ধরনের ঠেলাগাড়ি তৈরি করে তাতে পসরা সাজিয়ে ফেরি করে। যারা নিজেদের দেহে পণ্য বহন করে তাদের আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়। কেউ কেউ মাথায় ঝাঁকা নিয়ে ফল, শাকসবজি, মাছ, গৃহস্থালি বিভিন্ন সামগ্রী, ঝাড়ু ও বাঁশ বেতের সামগ্রী, বস্ত্র সামগ্রী প্রভৃতি ফেরি করে। কাঁধে দাঁড় বহন করে যারা পণ্য ফেরি করে তারা মাটির হাড়ি পাতিল, অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র, প­াস্টিক সামগ্রী এবং কখনও কখনও ফল বিক্রি করে।

কিছু কিছু হকার বিশেষ করে অল্প বয়সের কিশোর হকাররা গলায় বাক্স বা ট্রে ঝুলিয়ে বাদাম, চানাচুর, পান সিগারেট, চিরুনি, চুলের কাঁটাসহ মেয়েদের চুল সাজানোর বাহারি সামগ্রী, কৃত্রিম অলঙ্কার প্রভৃতি পণ্য ফেরি করে। সাধারণত যেখানে লোক সমাগম বেশি হয় এমন স্থানে এরা পণ্য ফেরি করে। যারা ঠেলাগাড়িতে করে পণ্য ফেরি করে এরা সচরাচর বড় আকৃতির ও ভারি মৌসুমি ফলফলাদি, যেমন: কাঁঠাল, তরমুজ প্রভৃতি; রান্না করা অথবা ভাজা খাদ্যসামগ্রী, যেমন: চটপটি, পিঁয়াজু, সিঙ্গারা প্রভৃতি; বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, প­াস্টিক সামগ্রী প্রভৃতি বিক্রি করে। এই শ্রেণীর হকাররা প্রধানত অফিস পাড়া ও স্কুল-কলেজ এলাকাকেই বেশি পছন্দ করে। ক্রেতারা কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার পথে অথবা ছেলেমেয়েদের স্কুল থেকে বাসায় ফেরত নেওয়ার পথে তাদের কাছ থেকে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করে। কিছু কিছু হকার আবার বাস, ট্রেন, লঞ্চ-স্টিমার ইত্যাদি যানবাহনে ঘুরে ঘুরে পণ্য বিক্রি করে। ভাসমান হকারদের দৈনিক গড় আয় ১০০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে।

আধা স্থায়ী হকাররা খদ্দেরের সহজলভ্যতা, আবহাওয়া এবং নিরাপত্তার ওপর ভিত্তি করে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে, তবে সাধারণত এলাকা পরিবর্তন করতে পছন্দ করে না। এই ধরনের হকাররা সাধারণত একই অবস্থানে ঘুরে-ফিরে তাদের ব্যবসাকার্য পরিচালনা করে এবং দিন শুরুতে তাদের পণ্যদ্রব্য সঙ্গে করে নিয়ে আসে ও দিন শেষে আবার সেগুলো গুটিয়ে নিয়ে চলে যায়। এই হকারদের স্থায়ী কোন অবকাঠামো থাকে না। কখনও কখনও এরা তাদের ঠেলাগাড়িটিকে নির্দিষ্ট স্থানে বিশেষ করে, কোন বাণিজ্যিক এলাকা অথবা জনসমাগমপূর্ণ স্থানে দাঁড় করিয়ে পণ্য বিক্রয় করে অথবা রাস্তার পাশের ফুটপাতে বসে পণ্য বিক্রয় করে। যেহেতু এদের কোন অবকাঠামো থাকে না, তাই গ্রীষ্মের রৌদ্র এবং বর্ষার বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এরা ছাতা অথবা পলিথিনের আবরণ ব্যবহার করে। ভোর থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত এই হকাররা তাদের বেচাকেনা চালিয়ে যায়। স্থায়ী অবকাঠামো না থাকায় এদের গড় ব্যয় খুবই কম। এদের দৈনিক গড় আয় ১৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে যারা ব্যস্ত স্থানে বসতে পারে তাদের আয় আরও বেশি হয়।

স্থায়ী হকারদের বাজার এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, বাস স্ট্যান্ড অথবা ব্যস্ত জনসমাগমপূর্ণ স্থানে ফুটপাত বা ওভারব্রীজের নিচে স্থায়ী দোকান বা স্টল থাকে। বিভিন্ন পৌর প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এরা এসব ক্ষুদ্র দোকান ভাড়া নেয়। সকল ধরনের হকারদের মধ্যে স্থায়ী হকারদের পুঁজি বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি। নিম্ন ও মধ্যম উভয় আয়ের জনগণই স্থায়ী হকারদের খরিদ্দার। এসকল ক্ষুদ্র দোকানে সাধারণত পত্র-পত্রিকা, কমদামি ফাস্ট ফুড, জুতা, তৈরি পোষাক প্রভৃতি বিক্রয় হয়।  [নাজনীন আফরোজ হক]