হক, মোহাম্মদ আজিজুল

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২৩:২০, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

মোহাম্মদ আজিজুল হক (১৮৯২-১৯৪৭)  আইনজীবী, অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান, সমাজসেবক ও লেখক। তিনি ১৮৯২ সালের ২৭ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার শান্তিপুরে জন্মগ্রহণ করেন। একটি রুচিশীল পরিবার ও হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সহাবস্থানমূলক সুন্দরতম সামাজিক পরিবেশে তিনি তাঁর প্রথম জীবন অতিবাহিত করেন। তাঁর নিজ শহর শান্তিপুর ছিল হিন্দু সংস্কৃতির পীঠস্থান এবং বাংলা ভাষার চর্চাকেন্দ্র। তিনি মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও সংস্কৃত, ফারসি, উর্দু এবং ইংরেজি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন।

আজিজুল হক ১৯০৭ সালে শান্তিপুর থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯০৯ ও ১৯১১ সালে যথাক্রমে এফ.এ ও বি.এ পাস করেন। এরপর তিনি ইউনিভর্সিটি ল’ কলেজে যোগ দেন এবং ১৯১৪ সালে বি.এল ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রজীবনের এ পর্বে কলকাতার বেকার হোস্টেলে তাঁর অবস্থানকালে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। তিনি মুসলিম ইনস্টিটিউটের কর্মকান্ডে এবং পশ্চাৎপদ মুসলমান সম্প্রদায়ের শিক্ষা সংক্রান্ত  সমস্যাদি বিষয়ে ইনস্টিটিউটের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। তিনি মেহনতি মুসলমান কৃষকদের কল্যাণের জন্য তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় এবং শ্রম ব্যয় করেন। ১৯১২ সালে যখন তিনি একজন আইনের ছাত্র এবং মুসলিম ইনস্টিটিউটের অবৈতনিক সম্পাদক ছিলেন, তখন Mohammedan Education শিরোনামে একটি পুস্তিকা রচনা ও প্রকাশ করেন।

মোহাম্মদ আজিজুল হক

মুসলমান ছাত্রদের দুর্দশার প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ তাঁকে একটি প্রবন্ধ লিখতে উদ্বুদ্ধ করে। এ প্রবন্ধটি তিনি বাংলার পাবলিক ইনস্ট্রাকশন-এর পরিচালক ডব্লিউ.ডব্লিউ হর্নেলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মুসলিম ইনস্টিটিউটের এক সভায় পাঠ করেন। পরে পরিচালকের উৎসাহ ও সমর্থনে হিস্টরি অ্যান্ড প্রোবলেমস অব মুসলিম এডুকেশন ইন বেঙ্গল নামে বই আকারে ১৯১৭ সালে প্রকাশিত হয়।

১৯১৪ সালে বি.এল পরীক্ষার পর তাঁর অভিভাবকরা চাইলেন তিনি যেন সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। এ সময় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগের প্রস্তাব পেলেও তিনি এতে অসম্মতি প্রকাশ করেন। এর পরিবর্তে তিনি ১৯১৫ সালে কৃষ্ণনগরের জেলা কোর্টে আইনজীবী হিসেবে আইন ব্যবসা শুরু করেন। এখানে তিনি স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। পরের বছর তিনি হুগলি জেলার সিমলাগড়ের কানিজ খাতুনকে বিবাহ করেন। তিনি স্থানীয় সরকার, বিভিন্ন সামাজিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। বাংলার ব্যয় সঙ্কোচন কমিটির রিপোর্টে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে বিপ্রাদেশিকীকরণের সুপারিশ করলে আজিজুল হক Education and Retrenchment (১৯২৪) শিরোনামে একটি পুস্তিকা রচনা করেন। এতে তিনি এসব সুপারিশের বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি পেশ করেন। তিনি মাদ্রাসাগুলিকে শিক্ষার মূল কাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। ১৯২৬ সালে তিনি নদীয়া জেলার সরকারি উকিল ও পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন এবং ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ঐ বছর তিনি বাংলার আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত হন।

১৯২৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোর্টের সদস্য হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন। ১৯২৯ সালে তিনি বাংলার আইন পরিষদে পুনরায় নির্বাচিত হন। ১৯৩১ সালে নেহরু রিপোর্ট এর প্রতিবাদে আজিজুল হক A Plea for Separate Electorate in Bengal শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এ পুস্তিকাতে তিনি মুসলিম দৃষ্টিভঙ্গির উপর আলোকপাত করেন। তাঁর মতে, যে সম্প্রদায়ের মধ্যে আর্থিক যোগ্যতা ও অসচ্ছলতার কারণে শিক্ষার স্তর নিচে এবং রাজনৈতিক সচেতনতা সংকীর্ণ, সে সম্প্রদায়ে বয়স ভোটাধিকার সঙ্গতিপূর্ণ প্রতিনিধিত্বের প্রতিফলন ঘটায় না। প্রায় একই সময়ে তিনি Cultural Contributions of Islam to Indian history শিরোনামে আরেকটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন।

১৯৩১ সালে আজিজুল হক ইন্ডিয়ান ফ্র্যাঞ্চাইজ কমিশনের সদস্য মনোনীত হন। এর পরের বছর তিনি বেঙ্গল ব্যাঙ্কিং ইনকোয়ারি কমিশন, বেঙ্গল রিট্রেঞ্চমেন্ট কমিটি এবং বেঙ্গল বোর্ড অব ইকোনমিক ইনক্যোয়ারি’র সদস্য হিসেবে কাজ করেন। তিনি রেলওয়ে এ্যাডভাইজরি কমিটি ও বাংলার আইন সভার পাবলিক একাউন্টস কমিটিতে কাজ করেন এবং বেঙ্গল বোর্ড অব ইন্ডাস্ট্রিজ-এর ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৩৩ সালে তিনি কৃষ্ণনগর পৌরসভার চেয়াম্যান নির্বাচিত হন। তিনি নয় বছর (১৯২৬-১৯৩৪) নদীয়া জেলা বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।

নদী ব্যবস্থার উপর বাংলার কৃষকদের নির্ভরশীলতা তাঁকে আঞ্চলিক নদীসমূহ এবং কৃষকদের সেচ সমস্যার উপর গবেষণা কাজে উদ্বুদ্ধ করে। ১৯২৬ সালে বাংলার আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সময় থেকে তিনি অনেক সিলেক্ট কমিটিতে কাজ করেন। ১৯২৮ সালের বেঙ্গল টেন্যান্সি অ্যাক্ট, ১৯৩৩ সালের বেঙ্গল মানি লেন্ডারস অ্যাক্ট, ১৯৩৫-৩৬ সালের বেঙ্গল অ্যাগ্রিকালচারাল ডেটরস অ্যাক্ট এবং ১৯৩৮ সালের বেঙ্গল টেন্যান্সি অ্যাক্ট পাস করার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। বাংলার কৃষকদের দুর্দশা লাঘবে নিরন্তর আগ্রহ তাঁকে The man behind the plough (১৯৩৯) নামের গ্রন্থটি রচনায় অনুপ্রাণিত করে। তিনি এর ভূমিকায় যেভাবে বর্ণনা করেছেন তাতে দেখা যায় যে, তিনি এ গ্রন্থে ‘গ্রামীণ জীবনের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্মোচন’ করার চেষ্টা করেছেন।

আজিজুল হক ১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত বাংলার শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। এ সময় তিনি রেজিস্ট্রেশন এবং ওয়াক্ফ-এরও দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর উদ্যোগে প্রাথমিক শিক্ষার এক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি থেকে মাতৃভাষায় পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে তিনি সহায়ক ভূমিকা পালন করেন।

আজিজুল হক নতুন সংবিধানের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনের ভিত্তিতে গঠিত আইন পরিষদের প্রথম স্পিকার ছিলেন এবং সি.আই.ই উপাধি লাভ করেন। তিনি পাঁচ বছর (১৯৩৭-১৯৪২) এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি ১৯৩৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পদে নিযুক্ত হন এবং ১৯৪০ সালে এ পদে পুনঃনিয়োগ লাভ করেন। তিনি চার বছর একাধারে এদুটি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি ১৯৪০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রমে বিষয় হিসেবে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়টি প্রবর্তন করেন। কামাল ইয়ার জং শিক্ষা কমিটিতে কাজ করার সুবাদে তিনি ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত ভারতীয় প্রদেশগুলিসহ সমগ্র ভারতের মুসলিম শিক্ষার সমস্যা সম্পর্কে গবেষণা করেন। তাঁর প্রতিবেদন ভারতীয় মুসলমানদের সংস্কৃতি ও সামাজিক শৃঙ্খলার সহায়ক শিক্ষার ব্যাপক ভিত্তিক পরিকল্পনা পেশ করে।

মোহাম্মদ আজিজুল হক ১৯৪১ সালে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট (সম্মানসূচক) উপাধি প্রদান করে। জার্মানদের প্রচন্ড বোমাবর্ষণে সৃষ্ট চরম সংকটময়কালে ১৯৪২ সালে তিনি লন্ডনে ভারতের হাই কমিশনার পদে নিযুক্ত হন। ব্রিটেনে অবস্থানকালে ভারতের বৈচিত্র্য ও অনৈক্যের অজুহাতে ব্রিটিশ সরকারের ভারতের স্বাধীনতা দিতে না চাওয়ার দাবি উপেক্ষা করে তিনি ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের বিষয়টি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে সকল সুবিধা কাজে লাগিয়েছিলেন।

১৯৪৩ সালে ভারতে প্রত্যাবর্তন করে তিনি ভাইসরয়-এর নির্বাহী কাউন্সিলে যোগ দেন। তাঁর উপর বাণিজ্য, শিল্প, বেসামরিক সরবরাহ, খাদ্য এবং পরে সরবরাহ বিভাগের অধীনে বস্ত্র দপ্তরের দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়। তিনি দুজন ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো এবং লর্ড ওয়াভেল-এর অধীনে নির্বাহী কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন।

তিনি ১৯৪৫ সালে রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর জীবন নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনার কাজ শুরু করেন। গ্রন্থটি রচনার কাজ সমাপ্ত হলেও, তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর কারণে তা অপ্রকাশিত থেকে যায়। ১৯৪৬ সালে তাঁকে উচ্চতর মর্যাদার নাইট উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৪৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পর আজিজুল হক কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং কলকাতা হাইকোর্টের তালিকাভুক্ত আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসের কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর কেন্দ্রীয় সরকার একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে। আজিজুল হক এ তদন্ত কমিশনের অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন। ভাইসরয়-এর কার্যক্রমের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগ কর্তৃক আহুত প্রতিবাদের সমর্থনে আজিজুল হক ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সকল উপাধি বর্জন করেন।

মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে ১৯৪৭ সালের ২৩ মার্চ তিনি ইন্তেকাল করেন।  [হুসনে আরা হক]

গ্রন্থপঞ্জি  Shahanara Alam & Husniara Huq (ed), M Azizul Huque, Life Sketch and Selected writings, Dhaka, 1984; Iqbal Bhuiyan, Sir Azizul Huque (in Bangla), Dhaka, 1994; Shahanara Alam & Husniara Huq (ed), Azizul Huque – A Biographical Account of his Life and Work, Dhaka, 1996.