সেখশুভোদয়া

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২৩:১১, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)

সেখশুভোদয়া সংস্কৃত গদ্য ও পদ্যে রচিত একখানি চম্পূকাব্য; রচয়িতা হলায়ুধ মিশ্র। এক হলায়ুধ মিশ্র গৌড়াধিপতি  লক্ষ্মণসেনএর সভাকবি ছিলেন। তাঁর সংস্কৃত ভাষায় রচিত ব্রাহ্মণসর্বস্ব ও কিছু স্মৃতিশাস্ত্র শ্রেণীর লেখা আছে। তিনি সেখশুভোদয়ার রচয়িতা হলে গ্রন্থের রচনাকাল বারো শতকের শেষ বা তেরো শতকের গোড়ার দিকে হওয়ার কথা। কিন্তু বিষয়, চরিত্র, ঘটনা, ভাষা ও অন্যান্য দিক বিবেচনা করে পন্ডিতগণ মনে করেন যে, গ্রন্থখানি ষোলো শতকের আগে রচিত হয়নি; সুতরাং এই হলায়ুধ মিশ্র ভিন্ন ব্যক্তি হবেন। কেউ কেউ মনে করেন, কোনো মুসলমান লেখক ‘হলায়ুধ মিশ্র’ ছদ্মনামে এটি রচনা করেছেন। সেখশুভোদয়ার সংস্কৃত ভাষা অশুদ্ধ ও দুর্বল; কোনো রাজকবি তা লিখতে পারেন না। এ কারণেই মনে করা হয় যে, এর লেখক ছিলেন মুসলমান।

সম্রাট আকবরের আমলে রাজা তোডরমল কর্তৃক বাংলায় জমি জরিপের সময় মালদহের বাইশ হাজারি মসজিদের ওয়াক্ফ সম্পত্তির দখলিস্বত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে শেখ শাহ্জালাল ও লক্ষ্মণসেনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন এবং ওই সম্পত্তির ভোগ-দলিলস্বরূপ এ গ্রন্থ প্রণীত হয়। উনিশ শতকের প্রথম দিকে মালদহের জেলাপ্রশাসক উমেশচন্দ্র বিদ্যালঙ্কার বটব্যাল বাইশ হাজারি মসজিদ থেকে গ্রন্থটি সংগ্রহ করেন। এটি অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে মসজিদে সংরক্ষিত ছিল এবং মাঝে মধ্যে পড়াও হতো। গ্রন্থটি পাঠের ফলে রোগশোক ও প্রেতাত্মার প্রভাব দূরীভূত হয় বলে লোকের বিশ্বাস।

সেখশুভোদয়ার এরূপ মর্যাদার প্রকৃত কারণ এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শেখ শাহ্জালালের অধ্যাত্ম মহিমা ও চারিত্রিক গুণাবলি। পীরের মাহাত্ম্য গেয়ে কবি  ইসলাম ধর্মের বিজয় ঘোষণা করেছেন। গ্রন্থে দরবেশের অলৌকিক আচরণ ও মহানুভবতার দিকটাই বেশি তুলে ধরা হয়েছে; অপরদিকে  হিন্দুধর্মএর নানা আচার-সংস্কারের সমালোচনা করা হয়েছে।

সেখশুভোদয়ায় মোট ২৫টি অধ্যায় আছে। প্রায় প্রত্যেক অধ্যায়ে এক বা একাধিক গল্প আছে এবং গল্পগুলি কখনও শেখের অভিজ্ঞতায়, কখনও লক্ষ্মণসেনের অভিজ্ঞতায়, আবার কখনও মন্ত্রি-যোগীর অভিজ্ঞতায় বর্ণিত হয়েছে। মূলত শেখ-সেনকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেই কাহিনীগুলি বিবৃত হয়েছে। বাদশাহ্ হারুনর রশিদকে কেন্দ্র করে আরব্য রজনী এবং বিক্রমাদিত্যকে কেন্দ্র করে বত্রিশ সিংহাসন গ্রন্থের অনুকরণে সেখশুভোদয়ার  কাহিনী-পরিকল্পনায় লেখকের কৃতিত্ব লক্ষণীয়। অধিকাংশ গল্পে একদিকে অলৌকিক ক্ষমতা ও আধ্যাত্মিক মহিমার অধিকারী শেখ শাহ্জালালের চরিত্রগৌরব এবং অন্যদিকে মসজিদ, খানকাহ প্রতিষ্ঠা ও ধর্মান্তরীকরণ প্রক্রিয়ায় ইসলাম প্রচার করা হয়েছে। মানুষকে নীতি-উপদেশ শিক্ষা দেওয়ার জন্য গল্পের মাঝে মাঝে কতিপয় জ্ঞানগর্ভ শ্লোক আছে।

সেখশুভোদয়ার  অপর বৈশিষ্ট্য হলো এতে বাংলা ভাষায় একটি বচন, দুটি গীত ও পাঁচটি ছড়া-জাতীয়  শ্লোক আছে। ডাকিনীদ্বয়ের ‘ভাটিয়ালীরাগেণ গীয়তে’ পদটিতে মানবিক এবং শেখের স্ত্ততিজ্ঞাপক পদটিতে ধর্মীয় আবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ভাষায় মধ্যযুগের লক্ষণ থাকলেও গ্রন্থটি খুব বেশি প্রাচীন নয়। সংস্কৃত গ্রন্থের মূল ঘটনা ও চরিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত এরূপ বাংলা গীত-ছড়া সংযোজনের তাৎপর্য কী, তা অনুধাবন করা যায় না।

[ওয়াকিল আহমদ]