সারি গান

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২৩:০৯, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

সারি গান  এক প্রকার  লোকসঙ্গীত, যা শ্রমসঙ্গীত বা কর্মসঙ্গীত নামেও পরিচিত। নৌকার মাঝি-মাল্লাদের গান হিসেবেই এর প্রধান পরিচয়। মাঝিরা সারিবদ্ধভাবে বসে বৈঠা টানার তালে তালে এ গান গায় বলেই এর নাম হয়েছে সারি গান। দলবদ্ধভাবে গানের তালে তালে কাজ করলে শ্রম লাঘব হয়, কাজে উদ্দীপনা বাড়ে এবং কঠিন কাজও সহজ হয়ে যায়। এ কারণে শ্রমিকদের মধ্যে সারি গানের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।

সারি গানের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মধ্যযুগের কবি বিজয়গুপ্তের পদ্মাপুরাণে। সেখানে  সঙ্গীত অর্থেই ‘সারি’ শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। পরবর্তীকালে মোগল নৌ-সেনাদের নৌকাবাইচের অনুকরণে গ্রামবাংলায়  নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার প্রচলন হলে তাতে এ গানের প্রসার ঘটে। আরও পরে কৃষিকাজের বিভিন্ন  স্তরে, যেমন হাল বাওয়া, ফসল নিড়ানো ও কাটা, ফসল তোলা ইত্যাদি এবং ছাদ পেটানোর সময় কৃষক-শ্রমিকরা এ গান ব্যবহার করতে থাকে। এতে তাদের শ্রম লাঘব হতো। বর্তমানে সারি গান কেবল শ্রমসঙ্গীত বা কর্মসঙ্গীতই নয়, চিত্তবিনোদন এবং প্রতিযোগিতামূলক খেলার অন্যতম উপাদান হিসেবেও বিবেচিত। সারি গান গ্রামবাংলার মানুষের হূদয়ে এক অনবদ্য আবেদনের সৃষ্টি করে।

সারিগান প্রধানত সমবেত কণ্ঠে পুরুষের গান, এককভাবে তা গাওয়া হয় না। তবে ছাদ পেটানোর কাজে মেয়েদের অংশগ্রহণ থাকায় এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ একত্রে সারি গান গায়। সারি গানে একজন বয়াতি থাকে, সে মূল গান গায় এবং ফাঁকে ফাঁকে দোহারদের ‘দিশা’ ধরিয়ে দেয়। দোহাররা সমবেত কণ্ঠে তা গেয়ে বয়াতিকে ক্ষণিক বিশ্রামের সুযোগ করে দেয়।

সারি গান তালপ্রধান; অবস্থাভেদে দ্রুত ও ধীর লয়ে গাওয়া হয়। তালপ্রধান এ কারণে যে, নৌকাবাইচের বৈঠা পানিতে ওঠা-নামার তালে তালে, ছাদ পেটানোর তালে তালে এ গানের তাল রক্ষা করা হয়। বাইচের নৌকা যখন বৈঠার টানে দ্রুত ছুটে চলে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তা দ্রুত লয়ে গাওয়া হয়। কিন্তু যখন মাঝি-মাল্লারা নদীর বুকে দাঁড় টানে, তখন নৌকার গতি থাকে মন্থর। তখন যে সারি গাওয়া হয় তা ধীর লয়েই হয়ে থাকে। মূলত কর্মে প্রেরণা, শ্রম অপনোদন ও চিত্তবিনোদন সারি গানের মূল উদ্দেশ্য। এ কারণেই সারি গানে বিষয়বৈচিত্র্য এসেছে। গানের বিষয়বস্ত্ত হিসেবে রাধাকৃষ্ণ, হরগৌরী ও নিমাইবিষয়ক গান, নর-নারীর প্রেমমূলক গান, প্রশস্তিমূলক গান, মরমি গান, হাস্যকৌতুক ও আক্রমণাত্মক গান এতে স্থান পায়। নৌকাবাইচের সময় সারি গানে ঢোল, মন্দিরা, করতাল ইত্যাদি  বাদ্যযন্ত্র ব্যবহূত হয়।

সারি গান বছরের যেকোনো সময় গাওয়া যায়। ছাদ পেটানোর সময় ছাড়া অন্য সময়ে এ গান পরিবেশনের স্থান হলো নদ-নদী-হাওর-বাঁওড় আর কৃষিক্ষেত। সারি গানের অঞ্চল বলতে সাধারণত পূর্ব এবং নিম্ন বঙ্গের ভাটি অঞ্চলকে বোঝায়। তবে অন্যান্য অঞ্চলেও এ গানের প্রচলন আছে। বিশেষত ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, পাবনা, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল প্রভৃতি অঞ্চলে সারি গান ব্যাপকভাবে প্রচলিত।  [মোমেন চৌধুরী]