সাভার

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২৩:০৮, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

সাভার  ঢাকা মহানগরী থেকে উত্তর-পশ্চিমে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-আরিচা সড়কের পাশে এবং বংশী ও ধলেশ্বরী নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। এলাকাটি মধুপুর প্লাইস্টোসিন উঁচু ভূমির দক্ষিণাংশের অন্তর্ভুক্ত। এর ভূমিস্তর বেশ উঁচু। উঁচু স্তরের ভূমি ‘চালা’ এবং দুই উঁচু ভূমির মাঝের নিচু অংশ ‘বাইদ’ নামে পরিচিত।

আধুনিক সাভার নামের উৎপত্তি সর্বেশ্বর বা সম্ভার শব্দ থেকে। সাভারের একটি গৌরবোজ্জ্বল অতীত আছে। সাত-আট শতক থেকে সাভারে প্রথম মানব বসতি গড়ে উঠতে থাকে। স্থানীয় কয়েকটি কিংবদন্তি এই এলাকার সঙ্গে জনৈক রাজা হরিশচন্দ্রকে সম্পৃক্ত করেছে। এরূপ বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, হরিশচন্দ্র  রাঢ় থেকে সাভারে এসে বংশী নদীর তীরে তাঁর রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখানে দুটি  শিলালিপি পাওয়া গেছে। একটি লিপি ক্ষোদিত আছে পোড়ানো ইটের টুকরায়। এতে হরিশচন্দ্র পাল নামে এক রাজার নাম উৎকীর্ণ আছে। অন্য লিপিটির অস্তিত্ব নিয়ে কিছুটা সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। মহেন্দ্র নামে এক রাজা এই লিপিটি প্রকাশ করেন এবং এতে উৎকীর্ণ রয়েছে তাঁর বংশ পরিচয়। শিলালিপির শ্লোকগুলিতে বলা হয়েছে, বুদ্ধের ভক্ত ও রাজা ভীমসেনের পুত্র রাজা ধীমন্তসেন ভবলীনার (বংশী ও ব্রহ্মপুত্র নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল) শক্তিশালী কিরাত অঞ্চল অধিকার করেছিলেন। তাঁর পুত্র রণধীরসেন এই রাজ্য হিমালয় পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেন এবং সম্ভার (সাভার) শহরে স্বীয় রাজনিবাস স্থাপন করেন। রণধীরসেনের পুত্র হরিশচন্দ্র ছিলেন একজন সন্ন্যাসী-রাজা (রাজর্ষি) এবং তাঁর পুত্র মহেন্দ্র ৭৯১ শকাব্দে (৮৬৯ খ্রি) একটি  মঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য যে, সাভারে গুপ্তোত্তর যুগের ৬টি স্বর্ণ মুদ্রা পাওয়া গেছে। মুদ্রাগুলির দুটিতে ‘শ্রীক্রম’ ও তৃতীয়টিতে ‘সুধন্য’  উৎকীর্ণ আছে। খুব সম্ভবত গুপ্তযুগের প্রথম দিকে সাভার একটি রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল।

সাভারে সর্বমোট ১৩টি প্রত্নস্থলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলি হলো: রাজা হরিশচন্দ্রের বাড়ি, রাজাসন, কোটবাড়ি, গন্ডারিয়া, কর্ণপাড়া, কলমা, সাইলা, ডগরমুড়া, মঠবাড়ি, মদনপুর, ফুলবাড়ি, কোন্দা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এই প্রত্নস্থলগুলিকে তিনটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা যায়, যেমন- প্রশাসনিক, ধর্মীয় ও মৃৎপাত্র নির্মাণ এলাকা বা আবাসিক এলাকা। সবকয়টি প্রত্নস্থলই সাভার ও সাভারের চারপাশে এবং বংশী নদীর পূর্বপাড়ে অবস্থিত। একটি স্থল থেকে অন্য স্থলের মধ্যে দূরত্ব দুই কিলোমিটারের বেশি হবে না। মৃৎপাত্র, ইট নির্মিত স্তূপ ও মঠ, ব্রোঞ্জের মূর্তি, স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, লৌহ নির্মিত বর্শা ফলক, দা, পাথরের যাঁতা, পোড়ামাটির ফলক, বাটখারা, ডাবার, চাকতি, নকশা করা ইট প্রভৃতি প্রত্নবস্ত্ত এই এলাকা থেকে পাওয়া গেছে। এইসব প্রত্নস্থলে প্রাপ্ত মৃৎপাত্রগুলি লাল, কালো ও ধূসর রঙের। সাধারণভাবে এগুলি মালশা এবং ছোট ও মাঝারি আকারের পাত্র ও কলসের মত। লাল মৃৎপাত্রগুলিতে কালো ডোরা এবং গলা ও দেহের অংশে চারদিকে বেষ্টন-রেখা ও জ্যামিতিক নকশা চিত্রিত। মৃৎপাত্রের কিছু ভাঙা টুকরা পাওয়া গেছে যাতে মাদুর ও দড়ির নকশা অঙ্কিত।

এখনও টিকে থাকা কোটবাড়ি ঢিবিটি সাভারে নদীর তীরে গড়ে ওঠা প্রাচীন বসতির একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। বর্তমানে ব্যাপকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত মাটির দেয়াল ঘেরা এই বৃহৎ ঢিবিটি আয়তাকার। অপর একটি প্রাচীন বসতি এলাকা হচ্ছে বর্তমানে নদীর কাছাকাছি অবস্থিত মঠবাড়ি। কমপক্ষে তিনটি এলাকায় বৌদ্ধ মঠের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এর একটি হচ্ছে স্থানীয়ভাবে পরিচিত হরিশচন্দ্র রাজার বাড়ি। সাভার বাজার বাস-স্টপেজের পূর্বদিকে মজিদপুর গ্রামে এর অবস্থান। সম্প্রতি এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন করা হয়েছে। এখান থেকে কিছুটা পূর্ব দিকে অবস্থিত রাজাসন। এখানে বৌদ্ধ নিদর্শনাদির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। ১৯২৫-২৬ সালে এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের পর চারটি ইমারতের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। আরও পাওয়া যায় দরজা বা জানালার উপরে নকশা করা পোড়ামাটির লিন্টেল, বুদ্ধ মূর্তি ও লিপি ক্ষোদিত বিষ্ণুমূর্তি। এগুলিকে সার্বিকভাবে সাত-আট শতকের নিদর্শন বলে ধরে নেওয়া হয়। ১৯৮৯-৯০ সালে রাজবাড়ি ঢিবি উৎখননের পর প্রশস্ত দেয়াল বেষ্টিত বর্গাকার একটি স্তূপ পাওয়া গেছে। মাটির তলা থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে একটি ‘হরিকেল’ রৌপ্য মুদ্রা, একটি স্বর্ণ মুদ্রা এবং ব্রোঞ্জের তৈরি বেশ কয়েকটি বুদ্ধমূর্তি। এই প্রত্নবস্ত্তগুলি সাত-আট শতকের দিকের বলে ধারণা করা হয়।

এই প্রত্নস্থলসমূহ ছাড়াও এই এলাকায় বেশ কয়েকটি প্রাচীন পুকুরের সন্ধান পাওয়া গেছে। স্থানীয় কিংবদন্তি মতে, রাজা হরিশচন্দ্র এক রাতের মধ্যে ৫০টি পুকুর খনন করান। এর মধ্যে ৩০টি পুকুরের নাম বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম থেকে জানা যায়। এগুলি হচ্ছে- সাগর দিঘি (রাজা হরিশচন্দ্রের বাড়ির নিকটে), রাজগুরুর পুকুর, ছোট খুদা, বড় খুদা, কুমারিয়া পুকুর, ডাকাইতমারা পুকুর, জোড় পুকুর, নিরামিষ পুকুর, কোদাল ধোয়া পুকুর, গিয়াস পুকুর, সতীনি পুকুর, আমিষ পুকুর, দোয়াত ধোয়া পুকুর, রাজ দিঘি, সুখ সাগর, খাটাইস্যা পুকুর (কলমার নিকট), জালরি পুকুর, বান পুকুর, ছোবামারা পুকুর, লাল পুকুর, সাতপুকুরি পুকুর, ছৈয়াল পুকুর, জলেশ্বরী পুকুর, পিটকিলা পুকুর, চোটি মারা পুকুর, অন্দর পুকুর, দ্বিতীয় কোদাল ধোয়া পুকুর, বুড়ির বাগ পুকুর, যোগীর পুকুর (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস) ও মুর পুকুর। এসব পুকুরের অধিকাংশই প্রাকৃতিক নিয়মে ভরাট হয়ে গেছে অথবা এগুলি ভরাট করে আবাসস্থল গড়ে তোলা হয়েছে।  [এম.এম হক]

গ্রন্থপঞ্জি  NK Bhattasali, 'The Math Inscription of Mahendra, Son of Harish Chandra of Sabhar', Dacca Review, 1920; GM Laskar, 'Notes on Raja Harish Chandra of Sabhar', Dacca Review, 1920; MM Hoque, SMK Ahsan and SSM Rahman, 'Pre-Muslim Settlement and Chronology of Savar Region', Pratnatattva, 1996; AKM Shahnawaz and MM Hoque, 'Savar: History and Archaeology', in Souvenir, 9th Bangladesh Science Conference, held in Jahangimagar University, 1996.