শ্রীরামপুর কলেজ

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২৩:০৪, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

শ্রীরামপুর কলেজ  ভারতবর্ষে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। ১৮১৮ সালে উইলিয়ম  কেরীজোশুয়া মার্শম্যান ও উইলিয়ম ওয়ার্ড নামে তিনজন মিশনারি দেশীয় পুরোহিত সম্প্রদায় সৃষ্টির মানসে ভারতীয় খ্রিস্টানদের প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে এই কলেজ নির্মাণ করেন। কিন্তু এর অন্য লক্ষ্যও ছিল। এখানে এশীয় খ্রিস্টান এবং অন্যান্য যুব সম্প্রদায়কে একই সঙ্গে প্রাচ্য সাহিত্য ও পাশ্চাত্য বিজ্ঞান পড়ানো হতো। সেকালে হিন্দু কলেজে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রচলিত থাকলেও তা সীমাবদ্ধ ছিল কেবল উচ্চবিত্তের মুষ্টিমেয় ছাত্রের মধ্যে। সর্বসাধারণের পড়বার সুযোগ সেখানে ছিল না। কেরী এবং তাঁর সহযোগিগণ সর্বসাধারণের জন্য একটি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুভব করেন। তাঁরা নিজেদের আয় থেকে দেড় লক্ষ টাকা ব্যয়ে কলেজ ভবনটি নির্মাণ করেন। এটি হচ্ছে সর্বপ্রথম এবং এখন পর্যন্ত ভারতের একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে ধর্ম, মানবিক বিদ্যা এবং ধর্মনিরপেক্ষ বিষয় একই সঙ্গে পড়ানো হয়।

প্রথমে মাত্র ৩৭ জন ছাত্র নিয়ে শ্রীরামপুর কলেজ শুরু হয়। শুরুতে মিশন ভবনে পাঠদানের কাজ চলত। ডেনিশ স্থপতি মেজর উইকেডি এই ভবনের নকশা প্রস্ত্তত করেন এবং পরে লর্ড  হেস্টিংস তা অনুমোদন করেন। ডেনমার্কের সম্রাট উপহার দেন কলেজের জন্য সুন্দর একখানি লোহার গেট ও দোতলায় ওঠার জন্য অপরূপ ডিজাইনের দুখানি সিঁড়ি। ১৮২২ সালে রাজকীয় আইওনিক স্তম্ভ এবং আকর্ষণীয় পোর্টিকো (portico) সহ হুগলি নদীর পশ্চিম তীরে ডেনিশ সরকার প্রদত্ত সাত একর জমির উপর দ্বিতল কলেজ ভবন নির্মিত হয়। শ্রেণিতে পাঠদানের কাজ নতুন কলেজ ভবনে স্থানান্তরিত হয় এবং মিশন গ্রন্থাগারটি চলে আসে কলেজের বিশাল একতলা কক্ষে।

শ্রীরামপুর কলেজ

এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র জন ম্যাক অচিরেই কেরী, মার্শম্যান ও ওয়ার্ডের সঙ্গে যোগ দেন। এরপর চারজন একসঙ্গে নিষ্ঠা ও অভিন্ন মতামতের ভিত্তিতে কাজ করতে থাকেন। ম্যাক হচ্ছেন প্রথম শিক্ষাবিদ যিনি ভারতে প্রথম মাতৃভাষায় শিক্ষাদান ও উন্নত যন্ত্রের সাহায্যে বিজ্ঞান শেখানোর কাজ শুরু করেন। কিন্তু ১৮২৩ সালে কলেজে দুটি বড় বিপর্যয় ঘটে- ওয়ার্ডের অকাল প্রয়াণ ও শ্রীরামপুরের বিধ্বংসী বন্যা কলেজকে বিশাল সংকটে ফেলে। অর্থ সাহায্যের জন্য ১৮২৬ সালে মার্শম্যানকে ডেনিশ সম্রাটের নিকট পাঠানো হয়। ডেনিশ সরকার শ্রীরামপুর কলেজকে ১৮২৭ সালে রাজকীয় সনদ প্রদান করে যার ফলে এটি ইউরোপের যে কোনও কলেজের সমগোত্রীয় হয়। শ্রীরামপুর কলেজই এশিয়ার মধ্যে উল্লিখিত সম্মান প্রাপ্ত প্রথম প্রতিষ্ঠান। ১৮৩৩ সালে কেরী রাজকীয় সনদ মোতাবেক কলেজের সংবিধান প্রস্ত্তত করেন। কিন্তু পরের বছর ৯ জুন তাঁর দেহাবসান ঘটলে কলেজ মারাত্মকভাবে বাঁধাগ্রস্ত হয়। এরপর প্রচন্ড অর্থাভাব, শ্রীরামপুরে ১৮৪৫ সালে ডেনিশ সরকারের পতন ও জন ম্যাকের অকাল প্রয়াণে শ্রীরামপুর কলেজ দারুণ সংকটের সম্মুখীন হয়। এতদ্সত্ত্বেও ১৮৫৭ সালে অধ্যক্ষ ডেনহ্যামের সময়ে কলেজটি সদ্য প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভ করে।

১৮৮৩ সালে সুমারের পরিচালনাকালে ব্যাপটিস্ট মিশনারি সোসাইটি ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়গুলিকে তুলে দিলে কলেজটি আক্ষরিক অর্থেই একটি ধর্মতাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ১৮৮৩ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত কলেজ খুবই সংকটময় সময় অতিবাহিত করে। কিন্তু ১৯০৬ সালে কলেজের নতুন যুগ শুরু হয়। এ সময় কলেজের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতারূপে খ্যাত জর্জ হাওয়েল অধ্যক্ষ হয়ে এসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির আমূল সংস্কার সাধন করেন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৯১০-১১ সালে কলেজের ব্যাপক প্রসার ঘটে। তাঁরই সময়ে উচ্চতর ধর্মতত্ত্ব বিভাগ খোলা হয়; কলা ও বিজ্ঞান বিভাগ দুটি পুনরায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভ করে; তৈরি হয় ছাত্রাবাস ও ল্যাবরেটরি ভবন। এ সময় শ্রীরামপুর কলেজ ‘বাংলার অক্সফোর্ড’ হিসেবে খ্যাত হয়। ১৯১৫ সালে শ্রীরামপুর কলেজ থেকেই সর্বপ্রথম ‘ব্যাচেলর অব ডিভিনিটি’ ডিগ্রি প্রদান করা হয়। ১৯১৮ সালে ‘স্যাডলার কমিশন’ শ্রীরামপুর কলেজ সম্পর্কে ভূয়সী প্রশংসা করে।

কলেজের শিক্ষার মান বজায় রাখতে হাওয়েলকে যথেষ্ট সংগ্রাম করতে হয়। ১৯২৪ সালে শ্রীরামপুর কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ স্নাতক স্তরে উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি অর্জন করে। এরপর বহু খ্যাতনামা শিক্ষক কলেজে যোগদান করেন  যাঁদের মধ্যে কয়েকজন বিশিষ্ট অধ্যাপক হলেন বীরেন ঘোষাল, হরিপদ শাস্ত্রী, রাধারমণ গাঙ্গুলী, কালীকৃষ্ণ মুখার্জী, এম.এন বিশ্বাস প্রমুখ। ১৯২৯ সালে হাওয়েল অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং ড. এ্যাঙ্গাসের হাতে কলেজের ভার অর্পিত হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শ্রীরামপুর কলেজ ভবনকে মিলিটারি হাসপাতাল করার জন্য সরকার দখল নেয়। অবশ্য তখনও কলেজের স্বাভাবিক কর্মকান্ড চলতে থাকে, তবে বিক্ষিপ্তভাবে। ড. এ্যাঙ্গাস, এম.এন বিশ্বাস ও অন্যান্য শিক্ষক এ সময় কলেজ চালু রাখতে ভূমিকা রাখেন। গ্রন্থাগারের একটি বড় অংশ স্থানান্তর করা হয় চন্দননগরে। এই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও শ্রীরামপুর কলেজ ১৯৪৩ সালে ৮ জন ছাত্রীকে নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কলা বিভাগে সহশিক্ষা প্রবর্তন করে। কাগজের দুষ্পাপ্যতার কারণে এ সময় লিখিত পরীক্ষার পরিবর্তে মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়।

শ্রীরামপুর কলেজের আধুনিক যুগ শুরু হয় ১৯৪৬ সালে কলেজটির অধিগ্রহণ মুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই উচ্চতর শিক্ষা লাভের প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের গভীর আগ্রহ দেখা যায়। কলেজে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি থেকে এর প্রমাণ মেলে যুদ্ধপূর্ব বছরগুলিতে গড়ে যেখানে ২৮০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হতো, ১৯৪৭ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৪৩৬ জনে। ১৯৫৭ সালে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হয় ১০৫২ জন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কলেজের উন্নতি ঘটে।

১৯৬১ সালে কলেজে মহাসমারোহে কেরীর দ্বি-শত জন্মবার্ষিকী উৎসব পালন করা হয়। ১৯৯২ সালে ভারতে কেরীর আগমনের দুইশত বছর এবং শ্রীরামপুর কলেজের ১৭৪ বছর পূর্তি উদ্যাপন করা হয়। ভারত সরকার এসবের স্মারকচিহ্ন হিসেবে ১৯৯৩ সালে বিশেষ ডাক টিকেট প্রকাশ করে।

শ্রীরামপুর কলেজ তার অস্তিত্বের মধ্য দিয়ে সেইসব প্রতিষ্ঠাতাদের আদর্শ ধারণ করে চলেছে যাঁরা বিশ্বাস করতেন,‘ঈশ্বরের কাছ থেকে সেরা বস্ত্তর চাইতে ঈশ্বরের জন্যই সেরা বস্ত্ত আহরণ কর’।  [প্রফুল্ল চক্রবর্তী]