রাত বংশ

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৫৪, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

রাত বংশ সমতটের একটি রাজবংশ। এ সম্পর্কে জানার একমাত্র উৎস হলো শ্রীধারণ রাতের কৈলান তাম্রশাসন। ১৯৪৫ সালের কিছু পূর্বে লেখটি কুমিল্লার প্রায় ২৭ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত কৈলান (বা কৈলাইন) নামক এক গ্রামে আবিষ্কৃত হয়। সামন্ত লোকনাথের ত্রিপুরা তাম্রশাসনের প্রায় অনুরূপ এ তাম্রশাসন ১৯৪৬ সালে সর্বপ্রথম দীনেশচন্দ্র সরকার ও পরবর্তীসময়ে নলিনীকান্ত ভট্টশালী এবং আরও অনেকে পাঠোদ্ধার করে প্রকাশ করেন।

কৈলান তাম্রশাসনটিতে প্রাচীন সমতট সম্পর্কে বিভিন্ন রকম আকর্ষণীয় তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু এর শাসকদের বংশীয় পরিচয় বা তাদের শাসন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্যের উল্লেখ নেই। রাত বংশের দ্বিতীয় শাসক শ্রীধারণ রাত তাঁর রাজত্বের ৮ম বর্ষে রাজধানী দেবপর্বত থেকে লেখটি প্রকাশ করেন। এ রাজকীয় সনদের মাধ্যমে রাজা দাতব্যকাজে ২৫ পাটক ভূমি দান করেন। এর মধ্যে ৪১/২ পাটক বৌদ্ধ সঙ্ঘ, ১৩ পাটক ব্রাহ্মণ এবং ৭১/২ পাটক সাময়িকভাবে থেকে যায় রাজার মন্ত্রীদের কাছে। বহুল পরিচিত গুপ্তিনাটন (ময়নামতীতে বা তার সন্নিকটে) এবং পটল্যিক (যা এখনও শনাক্ত করা যায় নি) এ দুটি বিষয়ে প্রদত্ত ভূমি অবস্থিত ছিল। এ ভূমিদানের বর্ণনা থেকে কতগুলি বিশেষ বিশেষ জায়গার নাম ও আঞ্চলিক শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন দশগ্রাম, অড়বগঙ্গ নদী, বিল্ল (বিল), নৌদন্ড (নৌদর), নৌশিবভোগ ইত্যাদি। উল্লিখিত নামগুলি এটা নিশ্চিত করে যে, এর মধ্যে কিছু কিছু স্থান এমন এক এলাকায় অবস্থিত, যেখানকার অধিবাসীদের জীবনে পানি আর নৌকার ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই ব্যাখ্যা থেকে আরও বোঝা যায় যে, অঞ্চলটির বর্ণিত ভৌগোলিক ও সংস্থানিক অবস্থা এখনও কৈলানসহ সমগ্র অঞ্চলের সাথে মিলে যায়, এমনকি লালমাই-ময়নামতী পাহাড়ি এলাকার বাইরে মধ্য কুমিল্লার অধিকাংশ অঞ্চলের সাথেও।

লেখটিতে এ বংশের শাসক পরম বৈষ্ণব শ্রীধারণ রাত, তাঁর পিতা ও পূর্বসূরি এবং এ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীজীবনধারণ রাত, যুবরাজ বলধারণ রাত এবং রাজার মাতা বন্ধুদেবীর নাম উল্লিখিত আছে। রাত বংশের উভয় রাজা সমতটেশ্বর উপাধি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কিছু সাধারণ স্তুতিবাদ ছাড়া এ তাম্রলেখ থেকে এই শাসক বা তাঁদের রাজত্বকাল সম্পর্কে আর কোন উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না।

তবে এতে রাজধানী ও ক্ষীরোদা নদীর অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর বর্ণনা রয়েছে। বিশাল রাজধানী শহরের কেন্দ্রে পর্বতদুর্গের অভ্যন্তরে ছিল প্রাসাদ। চারটি প্রধান দিকে প্রবেশ পথ থাকার কারণে বর্ণনায় ‘সর্বতোভদ্রক’ ব্যবহার করা যথার্থই হয়েছে। শহরটি ক্ষীরোদা নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল এবং নদীতে ‘হাতিরা জলকেলিরত, আর নদীর উভয়তীরে ছিল সারিবদ্ধ নৌকার ভিড়’।

রাত বংশের প্রতিষ্ঠাতা জীবনধারণ রাত একজন সামন্ত অধিপতিরূপে তাঁর জীবন শুরু করেন। সামন্ত লোকনাথের ত্রিপুরা লেখতে উল্লেখ আছে যে, তিনি এবং তাঁর অধিরাজ কোন এক নৃপ জীবধারণের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন, যিনি একই রাজের অধীনস্থ একজন শক্তিশালী উদ্ধত সামন্তপ্রধান ছিলেন। বর্তমানে পন্ডিতগণ তাঁকে নিশ্চিতভাবে কৈলান তাম্রলেখের জীবনধারণের সঙ্গে শনাক্ত করেন। ফলে লোকনাথ ও নৃপ জীবধারণ উভয়ে সমসাময়িক ছিলেন, এ বিষয়ে আর কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না। উভয়ের অধিরাজকে সমসাময়িক খড়গ বংশীয় শাসকের সাথে অভিন্ন বলে মনে করা হয়।

এই সমসাময়িকতার ভিত্তিতে এবং লেখমালায় প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে সমতটে রাত বংশের রাজত্বকাল খ্রিস্ট্রীয় সাত শতকের শেষার্ধে খড়গ বংশের পতনের পর নিরূপণ করা যায়। কখন ও কিভাবে সমতটে খড়গদের পতন ও রাত বংশের উত্থান ঘটে তা এখনও অজানা।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০ বছর পূর্বে কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার উরিস্বর (পাহাড়পুর ইউনিয়ন) গ্রামে খাল খনন উপলক্ষে মাটি খোঁড়ার সময় ঘটনাক্রমে রাতদের সম্পর্কীয় তিনটি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়। লেখ প্রাপ্তির স্থানটিতে পুরানো ইটের টুকরো ও ভাঙ্গা মৃৎপাত্রাদি ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ১৯৯৫ সালে উরিস্বরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের একটি পরিত্যক্ত পুকুর থেকে একটি ছোট মৃৎপাত্রভর্তি প্রাক-মুসলিম মুদ্রা পুনরুদ্ধার করা হয়। উরিস্বরের পার্শ্ববর্তী বাবুতিপারা নামক অঞ্চল থেকে আনুমানিক খ্রিস্টীয় দশ-এগারো শতকের পূর্ণাকার কৃষ্ণবর্ণের প্রস্তরনির্মিত সূর্যমূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। এই আবিষ্কার এ স্থানের প্রাচীনত্বের স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। রাত বংশের তিনটি তাম্রলেখ বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এগুলির পাঠোদ্ধার হলে রাত রাজবংশের ইতিহাস সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

শ্রীধারণ রাত বা তাঁর পিতা জীবনধারণ রাত উভয়ের কেউই লিখিত দলিলে কোন রাজকীয় উপাধি গ্রহণ করেন নি। এই তথ্য এবং সামন্ততান্ত্রিক অভিধা ‘প্রাপ্ত-পঞ্চ-মহাশব্দ’-এর ভিত্তিতে দীনেশচন্দ্র সরকার এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, রাতরা (এবং খড়গ বংশও) সম্ভবত অর্ধস্বাধীন সামন্তপ্রধান ছিলেন, যদিও লিপিতে তাঁদের অধীনস্থ অবস্থানের কথা কোথাও উল্লেখ নেই। তদুপরি লিপিতে রাজকীয় বা সাম্রাজ্যিক অভিধার অনুল্লেখের অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে, যা কখনই একজন শাসকের অধীনস্থতার বিষয় প্রমাণ করে না।

রাতদের এ পর্যন্ত জানা লিখিত দলিলসমূহ রাজধানী থেকে অনেক দূরে রাজত্বের বহিরাঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়েছে। এটা একেবারেই কাকতালীয় ঘটনা বলে মনে হয় না। প্রত্নতাত্ত্বিক এ লিপিসমূহের প্রাপ্তিস্থান প্রত্ন সম্পদে সমৃদ্ধ এবং এখনও পূর্ণাঙ্গভাবে এগুলিতে সমীক্ষা চালানো হয়নি। কখনও যদি ঐ অঞ্চলে সুষ্ঠুভাবে অনুসন্ধান করা হয়, তাহলে হয়তো সমগ্র সমতটের সাংস্কৃতিক অগ্রগতি সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য তথ্য উৎঘাটিত হতে পারে।  [এম হারুনুর রশীদ]