রহমান, হামিদুর

হামিদুর রহমান

রহমান, হামিদুর (১৯২৮-১৯৮৮) চিত্রশিল্পি ও চিত্রকলার শিক্ষক। তিনি ১৯২৮ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। চিত্রশিল্প বিষয়ে তাঁর পড়াশুনা, ঢাকার বাংলাদেশ কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফ্টস (১৯৪৮-৫০), প্যারিসের ইকলে দ্য বু আর্ট (Ecole des Beux Arts) (১৯৫০-৫১) এবং লন্ডনস্থ সেন্ট্রাল স্কুল অব আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন-এ সম্পন্ন হয়েছে। ১৯৫৩ সালে তিনি ইতালির ফ্লোরেন্সে আকাদেমি দ্য বেল আর্ট (Academy de Belle Art) নামক বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে ম্যুরাল পেইন্টিং-এর ওপর গ্রীষ্মকালীন প্রশিক্ষণে অংশ নেন। পরবর্তীকালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়াস্থ পেনসিলভেনিয়া অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এ রিসার্চ স্কলার হিসেবে কাজ করেন (১৯৫৮-৫৯)। তিনি কানাডার মন্ট্রিল-এ ম্যাকডোনাল্ড অ্যান্ড কার্টিয়ার পলিটেকনিক নামক প্রতিষ্ঠানে ফাইন আর্টস-এর প্রফেসর ছিলেন।

ছাত্র হিসেবে হামিদুর রহমান সমসাময়িক পাশ্চাত্য চিত্র রীতির প্রতি অনুরাগী ছিলেন। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে সকল চিত্রশিল্পি তাদের ক্যানভাসে বিমূর্ত প্রকাশভঙ্গির সাথে বাস্তব জীবনের টানাপড়েন ও সংঘাতের সমন্বয় ঘটান তাদের শিল্পকর্মের প্রতি রহমান আকৃষ্ট হন। হামিদুর রহমান নিজেও ১৯৬০-এর দশকে কিছুদিনের জন্য এ রীতি অনুসরন করেন, তবে এই রীতি কিংবা অন্য কোন বিশেষ রীতির প্রতি তিনি কখনওই পরিপূর্ণভাবে আবদ্ধ থাকেন নি। শিল্পি জীবনের শুরুতে তিনি বিশেষ শিল্পরীতির গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন, যখন তিনি প্রচলিত রীতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট হন। রীতি ও পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাঁকে রোমান্টিকতার আদর্শ ও কেতাবি বাস্তবতার মূল ধারার প্রতি জিজ্ঞাসু করে তোলে এবং তিনি তা পরিহার করেন।

তিনি ছিলেন রূপান্তরশীল নন্দনতত্ত্বে বিশ্বাসী, যা ঐতিহ্যিক প্রতিকৃতি ও মূর্তির সংগ্রহশালার ভেতর দিয়ে বাছাই হতে হতে গুরুত্বপূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করে। তিনি নিজেই প্রতীক হিসেবে নৌকা ও মাছের বহুল প্রয়োগ করেছেন এবং ঐতিহ্যগত প্রতীক ও বিমূর্ত অশরীরী প্রতিকৃতির মধ্যে কোন প্রকার দ্বন্দ্ব তাঁর দৃষ্টিগোচর হয়নি।

হামিদুর রহমানের চিত্রকর্ম অতীতের নান্দনিক ঐতিহ্যের সাথে এভাবে একটা সাযুজ্য বজায় রেখে চলে। অবশ্য সদাই তিনি এগুলির নতুন নতুন ব্যাখ্যা দেন। তাঁর স্বকীয় মর্জি ও মানসিকতার ছাপে এগুলি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। অঙ্কনশৈলী ও উপকরণাদি নিয়ে অবিশ্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফসল তাঁর অলঙ্কার বর্জিত সাদামাটা চিত্রকর্মসমূহ। অভিব্যক্তিপূর্ণ চিত্রকর্মসমূহ জীবন যুদ্ধে ব্যর্থ জনগণের প্রতি তাঁর সংবেদনশীলতাকে ফুটিয়ে তোলে। তাঁর অলঙ্কৃত চিত্রকর্মসমূহ ব্যক্তির মুখাবয়বে ফুটে ওঠা অনুভূতি ও ভাবলেশহীন অভিব্যক্তিকে প্রকাশ করে। এ ব্যাপারে রঙের প্রয়োগে তাঁর মুন্সিয়ানা প্রকাশ পায়। তুলির টানে, রঙের প্রয়োগে অপ্রতীকী চিত্রকর্মেও (non-representational) রহমান একই রকম ভাব ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় হামিদুর রহমান শহীদ মিনারের নকশা অঙ্কনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। শহীদ মিনার এর সাদা মাটা অবয়ব সত্ত্বেও বাঙালি জাতির আবেগকে তীক্ষ্ণভাবে জাগরুক রাখে। রহমান শহীদ মিনারের জন্য কয়েকটা ম্যুরালও অঙ্কন করেন। এগুলি জাতির আত্মপরিচয়ের সংগ্রামকে বাঙ্ময় করে তোলে। দেশে বিদেশে তাঁর কৃত ম্যুরালসমূহে (১১০০০ বর্গফুট দেয়ালগাত্র) ঐতিহ্যিক মূর্তি ও প্রতিকৃতি সম্পর্কে রহমানের ব্যাখ্যা সুস্পষ্ট। তবে স্থাপত্যিক মূল্য এগুলিকে শেষ পর্যন্ত চেনা পরিমন্ডলে স্থিত করেছে। তাঁর ম্যুরালের মধ্যে বোরাক দুলদুল, জেলে পল্লী, নৌকা ইত্যাদি বেশি পরিচিতি পেয়েছে। এগুলি তিনি ১৯৫৭-৫৮ সালে তদানীন্তন পাবলিক লাইব্রেরির জন্য অঙ্কন করেন। ধারণাগতভাবে জ্যামিতিক রেখাশ্রয়ী চিত্রশিল্পি হওয়া সত্ত্বেও হামিদুর রহমানের চিত্রকর্ম স্বীকৃত কোন ধারার মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি। উদাহরণস্বরূপ ১৯৫৬ সালে তাঁর প্রথম বিমূর্ত চিত্রকর্মসমূহের প্রদর্শনীর কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি আধা-বাস্তব অবয়বকে এমনভাবে বিন্যস্ত করেন যাতে তা বিমূর্ত হয়ে ওঠে। বিভিন্ন রীতি থেকে সংগৃহীত ধারণার সংশ্লেষ ঘটিয়ে তিনি তাঁর নিজস্ব অঙ্কনশৈলী গড়ে তোলেন। কিন্তু সর্বক্ষণ তাঁর প্রয়াস ছিল চিত্ররীতির সতত পরিবর্তনের সাথে নিজেকে ও নিজের চিত্রকর্মকে সমতালে এগিয়ে নেওয়ার। ১৯৮৮ সালে হামিদুর রহমানের মৃত্যু হয়। [সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম]