মৌলভীবাজার জেলা

মৌলভীবাজার জেলা (সিলেট বিভাগ)  আয়তন: ২৬০১.৮৪ বর্গ কিমি। অবস্থান: ২৪°০৮´ থেকে ২৪°২৯´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°৩৬´ থেকে ৯২°১৭´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ।। সীমানা: উত্তরে সিলেট জেলা, দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্বে ভারতের আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্য, পশ্চিমে হবিগঞ্জ জেলা।

জনসংখ্যা ১৭৮০৭৯৭; পুরুষ ৯০৪৯১৮, মহিলা ৮৭৫৮৭৯। মুসলিম ১২৮১৭৭৩, হিন্দু ৪৮২৯৫২, বৌদ্ধ ১৪১৮৯, খ্রিস্টান ২৯ এবং অন্যান্য ৩০। উপজাতীয়দের মধ্যে মণিপুরী, খাসিয়া, ত্রিপুরা, হালাম উল্লেখযোগ্য।

জলাশয় প্রধান নদী: মনু, ধলাই, জুড়ী, লংলা। হাকালুকি, হাইল ও কাউয়াদিঘি হাওর উল্লেখযোগ্য।

প্রশাসন মৌলভীবাজার মহকুমা গঠিত হয় ১৯৬০ সালে এবং মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৪ সালে। পৌরসভা গঠিত হয় ১৯৩০ সালে।

জেলা
আয়তন (বর্গ কিমি) উপজেলা পৌরসভা ইউনিয়ন মৌজা গ্রাম জনসংখ্যা ঘনত্ব (প্রতি বর্গ কিমি) শিক্ষার হার (%)
শহর গ্রাম
২৬০১.৮৪ ৬৭ ৯১৭ ২১৩৪ ১৫০৩০১ ১৬৩০৪৯৬ ৬২৫ ৪২.৬৬
জেলার অন্যান্য তথ্য
উপজেলার নাম আয়তন(বর্গ কিমি) পৌরসভা ইউনিয়ন মৌজা গ্রাম জনসংখ্যা ঘনত্ব (প্রতি বর্গ কিমি) শিক্ষার হার (%)
কমলগঞ্জ ৫৬ ১১৯৯১২ ১১১ ২৫১ ২২৯৬৪৮ ৪৭৩ ৪০.৬৭
কুলাউড়া ৬৫ ১৬৭৮৪৭ ১৩ ১২১ ৪৭০ ৩৯৫৮৭৮ ৭০৯ ৫১.০৮
জুড়ী ৫৮৯২০ - ৯২ ১৪৪ ১৬৮৪২৩ ৭০৬ ৩৯.৭৯
মৌলভীবাজার সদর ৭৪ ৮৫০৮৫ ১২ ১৯২ ৪৩৪ ২৮১৫৯৩ ৮১৮ ৪৮.৬
বড়লেখা ১৪ ১২৩৯৫৮ ১০ ১৫০ ৩২৫ ২৩৩৭২০ ৪৮০ ৪২.৬৯
রাজনগর ৮০ ৮৩৫৬০ - ১৪২ ২৫৯ ১৯৩৩০৩ ৫৭২ ৩৬.২
শ্রীমঙ্গল ৮৩ ১১১৭৯ ১০৯ ২০৭ ২৭৮২৩২ ৬১৭ ৩৯.৫৭

সূত্র আদমশুমারি রিপোর্ট ২০০১, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো।

মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এ জেলা ৪ নং সেক্টরের অধীন ছিল। ২৭ মার্চ মৌলভীবাজার সদরের শ্রীরাইনগর গ্রামে সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হয়। সেখানে জনগণের এক মিছিলে পাকবাহিনী হঠাৎ আক্রমণ করলে দু’জন নিহত হন। মনুমুখ, কামালপুর ও শেরপুরসহ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘর্ষ হয়। ২৭ মার্চ বড়লেখা উপজেলায় সূচিত হয় প্রতিরোধ এবং ৬ মে পর্যন্ত শত্রু মুক্ত ছিল। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। ২৯ মার্চ কমলগঞ্জ উপজেলায় ইপিআর জওয়ান ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত প্রতিরোধে বহু পাকসেনা নিহত হয়। ৩০ এপ্রিল পাকবাহিনী শ্রীমঙ্গলে প্রবেশ করে হত্যা, লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন এবং অগ্নিসংযোগ করে। ৭ মে রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও গ্রামে পাকবাহিনী ৫৯ জনকে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করে। পাকবাহিনী মুন্সিবাজারের ধরবাড়ি ও শাহাজীবাড়ির ১৫ জন নিরীহ লোককে হত্যা করে। ১৪ মে পাকবাহিনী উত্তর ভাগ, চাটুরা, মহলাল, পঞ্চেশ্বর ও রাজনগরে গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগ করে। পাকবাহিনীর সঙ্গে এক মুখোমুখি সংঘর্ষে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ২ ও ৩ ডিসেম্বর কুলাউড়া উপজেলার ফুলতলা, সাগরনাল ও কাপনাপাহাড় এলাকায় যৌথবাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর লড়াই সংঘটিত হয়। ৪ ডিসেম্বর ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা রাজনগর উপজেলার উদনা চা বাগানে অবস্থিত পাকবাহিনী ক্যাম্প দখল করে। বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান কমলগঞ্জের সীমান্ত এলাকার আমবাসা গ্রামে শহীদ হন। পাকবাহিনী কুলাউড়া হাসপাতাল ও নবীনচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। এসময় পাকবাহিনী কুলাউড়ার বিভিন্ন এলাকার প্রায় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ লোককে হত্যা করে। জুড়ী উপজেলার আওতাধীন এলাকায় শহরে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের নিয়ন্ত্রনাধীন বিভিন্ন চা কারখানায় হামলা চালায় এবং কালভার্ট ও ব্রিজ ধ্বংস করে দেয়। ৪ ডিসেম্বর জুড়ি শত্রুমুক্ত হয়। ৬ ডিসেম্বর বড়লেখা ও রাজনগর উপজেলা শত্রুমুক্ত হয়।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন বধ্যভূমি: ৬, গণকবর: ৯, স্মৃতিস্তম্ভ: ৭।

শিক্ষার হার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড় হার ৪২.৬৬%; পুরুষ ৪৫.৬%, মহিলা ৩৮.৫%। কলেজ ২৪, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৫৮, প্রাথমিক বিদ্যালয় ১১০৩, সমবায় ইনস্টিটিউট ১, যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ১, নার্সিং ইনস্টিটিউট ১, ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ১, চা গবেষণা ইনস্টিটিউট ১, উদ্যানতত্ত্ব ও গবেষণা কেন্দ্র ইনস্টিটিউট ১, প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ১, অন্ধগুকল্যাণ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ১, মাদ্রাসা ১০৮। উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ (১৯৫৬), মৌলভীবাজার সরকারি মহিলা কলেজ (১৯৮৫), আব্দুল গফুর চৌধুরী মহিলা কলেজ (২০০০), শ্রীমঙ্গল সরকারী কলেজ, রাজনগর ডিগ্রি কলেজ (১৯৭৩), মৌলানা  মুফাজ্জল হোসেন মহিলা কলেজ (১৯৯৪), তৈয়বুন্নেছা খানম একাডেমী ডিগ্রি কলেজ (১৯৯৪), জগৎসী গোপাল কৃষ্ণ এম সাইফুর রহমান স্কুল এন্ড কলেজ (১৯১৫), মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় (১৮৯১), রাজনগর পোর্টিয়াস উচ্চবিদ্যালয় (১৮৯৩), কালী প্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয় (১৮৯৫), দশরথ বহুপাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয় (১৮৯৬), কাশীনাথ আলাউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় (১৯১৭), বিটি আর আই হাইস্কুল এন্ড কলেজ, দি বাড্স রেসিডেন্সিয়াল মডেল হাইস্কুল এন্ড কলেজ, ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় (১৯২৪), শমসেরনগর এএটিএম উচ্চ বিদ্যালয় (১৯২৯), আলী আমজাদ সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় (১৯৩২), এমএ ওহাব উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৩৩), কমলগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৩৪), তেঁতইগাঁও রশিদউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৫৪), দয়াময়সিংহ উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৭৩), হাজী উস্তওয়ার উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় (১৯৮৩), আবুল ফজল চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৮৫), জুড়ী উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৯৪), সুজা মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৯৪), একাসন্তোষ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৮৮০), ডোবারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৮৮২), চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৯২৪), বাসুদেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৯৩০), চন্দ্রনাথ প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৯৩৪), শমসেরনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৯৪৬), রানীরবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৯৫৩), রাজদিঘিরপার প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৯৭২), তেঁতইগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৯৭৮), উত্তরসুর কুলচন্দ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঘড়গাঁও হেদায়েতুল ইসলাম টাইটেল মাদ্রাসা (১৯২৬), নয়াবাজার আহমদিয়া ফাজিল মাদ্রাসা (১৯৫৮), রাজনগর ডিএস ফাজিল মাদ্রাসা (১৯৭৩), দারুল উলুম মাদ্রাসা।

জনগোষ্ঠীর আয়ের প্রধান উৎস কৃষি ৪০.৩৭%, অকৃষি শ্রমিক ১৩.১৩%, শিল্প ১.৬৩%, ব্যবসা ১১.২৯%, পরিবহণ ও যোগাযোগ ২.২০%, চাকরি ৬.৬২%, নির্মাণ ১.৪৪%, ধর্মীয় সেবা ০.৪০%, রেন্ট অ্যান্ড রেমিটেন্স ৪.৭১% এবং অন্যান্য ১৮.২১%।

পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকী দৈনিক: মৌলভীবাজার বার্তা, বাংলার দিন, খোলা চিঠি; সাপ্তাহিক: পাতাকুঁড়ির দেশ, মনু বার্তা, জনপ্রত্যাশা, মুক্তকথা, মানব ঠিকানা, হেফাজতে ইসলাম, মৌলভীবাজার দর্পণ, আল ইনসান, শ্রীমঙ্গলের চিঠি, শ্রী বাণী, পূবালী বার্তা, শ্রী ভূমি, জয় বার্তা, কুলাউড়ার ডাক, রাজকণ্ঠ; পাক্ষিক: সিলেট টু ডে, বহ্নি শিখা; মাসিক: দূর দিগন্ত, শ্রী গৌরবাণী। অবলুপ্ত: মাসিক তবলিগুল ইসলাম ও তানজিমুল মুসলিমিন (১৯২৪), শ্রীহট্ট ভ্রমণ-পরিদর্শন (১৯৩০), সাপ্তাহিক অভিযান (১৯৩৫), মাসিক খ্রিস্টান জগৎ (১৯৩৫), ত্রৈমাসিক ব্রতী (১৯৩৬), সাপ্তাহিক নকিব (১৯৩৭), বার্ষিক আবাহনী (১৯৩৯), সাপ্তাহিক অগ্রদূত (১৯৬০), মাসিক বন্যা (১৯৭০), সাপ্তাহিক বিপ্লবী বাংলা (১৯৭২), সাপ্তাহিক মুক্তবার্তা (১৯৭২), সাপ্তাহিক ফরিয়াদ (১৯৮৭)।

লোকসংস্কৃতি রাসনৃত্য, খাম্বা-থোইবি, লাই-হারাওবা, থাবল-চংবা, মৃদঙ্গনৃত্য, দোল-উৎসব, বিষু-উৎসব, করমপূজা, কাঠি-নৃত্য, ঝুমুর নৃত্য, শব্দকর সম্প্রদায়ের চড়ক-নৃত্য, প্রবাদ, পই, ডিটান, ধাঁধা, প্রবচন, ডাক, গীত, বিয়ের গান, ধামাইল গান, বাউল গান, সারি গান, বাউলা গান, লাচাড়ি, বান্ধা গান, বারোমাসি, মালজোড়া গান, বিচ্ছেদের গান ইত্যাদি।

দর্শনীয় স্থান মাধবকুন্ড জলপ্রপাত (বড়লেখা), মাধবপুর লেক, পরীকুন্ড, মনু ব্যারেজ, হাকালুকি হাওর (কমলগঞ্জ), মুরাইছড়া ইকোপার্ক, রাবার বাগান ও টিলা (কুলাউড়া), বর্ষিজোড়া ইকোপার্ক, চা বাগান ও মনু ব্যারেজ (মৌলভীবাজার সদর), লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট, ভাড়াউড়া লেক, মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি ও গ্যাসকূপ, ডেনস্টন সিমেট্রি (শ্রীমঙ্গল)। [শাহ আবদুল ওদুদ]

আরও দেখুন সংশ্লিষ্ট উপজেলা।

তথ্যসূত্র  আদমশুমারি রিপোর্ট ২০০১, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো; মৌলভীবাজার জেলা সাংস্কৃতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০০৭, মৌলভীবাজার জেলার উপজেলাসমূহের সাংস্কৃতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০০৭।