মোক্ষ

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৪৮, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

মোক্ষ  ভারতীয় ধর্মদর্শনের একটি ধারণা।  সাধারণভাবে ‘মোক্ষ’ শব্দের অর্থ দুঃখ বা বেদনাদায়ক অবস্থা থেকে চিরদিনের নিষ্কৃতি। এই অবস্থা লাভে জীব শান্তি ও পরিপূর্ণতা লাভ করে। তাই চার্বাক ব্যতীত ভারতীয় দর্শনের আস্তিক-নাস্তিক সকল সম্প্রদায় মোক্ষলাভের জন্য সচেষ্ট হতে আহবান করে। ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ-এই চারটিকে পুরুষার্থ বলা হয়। জীবনের পরিপুষ্টি ও পরিপূর্ণতার জন্য এই চারটিই একান্ত আবশ্যক।

‘মোক্ষ’ শব্দের অর্থ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কারো কারো মতে, ইচ্ছামাত্রই অবিদ্যা এবং অবিদ্যা নাশই মোক্ষ। অনেকের মতে, কামনা-বাসনার বিনাশই মোক্ষ। আবার কেউ কেউ মনে করেন, অনিত্য পৃথিবীর সাংসারিক সুখ-দুঃখ এবং অন্যান্য বস্ত্তর প্রতি যে মমতার সৃষ্টি হয় তার ক্ষয়ই মোক্ষ। অর্থাৎ, যেকোনো বন্ধন ছিন্ন করাই মোক্ষ। এ ছাড়া, কারো কারো মতে, মোক্ষ হচ্ছে এক আনন্দময় পরমশান্তির অবস্থা। তবে অধিকাংশ ভারতীয়দের মতে, মোক্ষ হচ্ছে ‘পরম পুরুষার্থ’ অর্থাৎ মোক্ষলাভ হলে আর কিছুই কামনার থাকে না, আমাদের সব প্রয়োজনের অবসান ঘটে।

মোক্ষের স্বরূপ ও প্রকৃতি নিয়ে ভারতীয় দার্শনিকদের মধ্যে মতপার্থক্য লক্ষ করা যায়। বৌদ্ধদর্শনে জগৎ দুঃখময় হলেও দুঃখের নিবৃত্তি সম্ভব। এই দুঃখের নিরোধকেই নির্বাণ বলে অভিহিত করা হয়। নির্বাণ ও মোক্ষ সমার্থক। গৌতমবুদ্ধ অবিদ্যাকেই দুঃখের মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। তাঁর মতে অষ্টাঙ্গিক মার্গ অর্থাৎ সম্যক্ দৃষ্টি, সম্যক্ সংকল্প, সম্যক্ বাক্, সম্যক্ কর্মান্ত, সম্যক্ আজীব, সম্যক্ ব্যায়াম, সম্যক্ স্মৃতি ও সম্যক্ সমাধির মাধ্যমেই নির্বাণ সম্ভব হয়। নির্বাণ দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি। এরূপ অবস্থায় জীবের দুঃখ, কামনা-বাসনার অবলুপ্তি ঘটে, জরা-মরণ রহিত হয় এবং পুনর্জন্মের সম্ভাবনা থাকে না। তাই নির্বাণ হচ্ছে সত্তার পূর্ণ অবলুপ্তি।

জৈন দার্শনিকদের মতে, কামনা-বাসনা ও ভোগ-লালসার কারণে জীব কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হয়। কর্মবন্ধন হলো জড়ের বন্ধন তথা পদগুলের বন্ধন। কর্ম-পদগুলের কারণেই জীবের বদ্ধাবস্থা লাভ হয়। এই বদ্ধাবস্থায় আত্মার স্বরূপ আবৃত থাকে। সুতরাং এই বদ্ধাবস্থা থেকে মুক্তি তথা পদগুলের বিযুক্তিই হচ্ছে মোক্ষ। চিত্ত শুদ্ধির দ্বারা ত্রিরত্ন অর্থাৎ সম্যক্ দর্শন, সম্যক্ জ্ঞান ও সম্যক্ চরিত্রের মাধ্যমে আত্মার মোক্ষপ্রাপ্তি হয়। এরূপ অবস্থায় আত্মা তার স্বরূপে অধিষ্ঠিত হয় অর্থাৎ অনন্ত জ্ঞান, অনন্ত শক্তি, অনন্ত দর্শন ও অনন্ত আনন্দ লাভ করে এবং সঞ্চিত ও সঞ্চীয়মান কর্ম-পদগুল বন্ধন বিচ্ছিন্ন  করে। এই ‘পদগুল’ বন্ধন বিচ্ছিন্ন করার সাধনাই হলো মোক্ষসাধনা এবং ‘পদগুল’ বন্ধন-মোচনই মুক্তি। মোক্ষ প্রাপ্ত আত্মা অনাবিল ও অনন্ত সুখের অধিকারী হয়।

ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে জীবের পরমপুরুষার্থ হচ্ছে মোক্ষ বা অপবর্গ। অপবর্গের অর্থ হচ্ছে আত্যন্তিক দুঃখমুক্তি। জীবের মুক্তাবস্থায় আত্মার স্থূলদেহ বা সূক্ষ্মদেহ থাকে না। দেহের সঙ্গে সংযোগ থাকলে  আত্যন্তিক দুঃখমুক্তি হয় না। কারণ দেহের কারণে ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তিগুলো বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং পরিণামে দুঃখ-কষ্টের অধীন হয়। তাই জন্মগ্রহণই হচ্ছে দুঃখের মূল এবং জীবের অবিদ্যার কারণেই দুঃখের সৃষ্টি। ন্যায়-বৈশেষিক দার্শনিকগণের মতে, অবিদ্যা থেকে দোষ, দোষ থেকে প্রবৃত্তি, প্রবৃত্তি থেকে জন্ম এবং জন্ম থেকে দুঃখের সৃষ্টি হয়। তাঁরা বলেন, তত্ত্বজ্ঞান তথা যথার্থ জ্ঞানলাভে জীবের মুক্তি হয়। আর তত্ত্বজ্ঞানের জন্য প্রয়োজন শ্রবণ, মনন, ও নিদিধ্যাসন। তত্ত্বজ্ঞানলাভের পরও জীবকে আরদ্ধ কর্মফল ভোগের জন্য জীবিত থাকতে হয় যার নাম জীবন্মুক্তি। জীবন্মুক্ত অবস্থায় জীবকে নিষ্কাম কর্ম পালন করতে হয়। এ অবস্থায় জীবের বিদেহ মুক্তি ঘটে  অর্থাৎ এরূপ অবস্থায় আত্মার পুনর্জন্মলাভের আর কোনো সম্ভাবনা থাকে না। ন্যায়-বৈশেষিকগণ এরূপ মুক্ত অবস্থাকে ‘মোক্ষ’ নামে অভিহিত করেন।

সাংখ্য-যোগ দার্শনিকদের মতে, পুরুষ বা আত্মা স্বরূপত নিত্যমুক্ত ও বিশুদ্ধ চৈতন্য বলে তার বন্ধন বা মুক্তি বলতে মূলত কোনো কিছু নেই। চিত্তের বিকারকে অবিবেকবশত নিজের মনে করাই তার বন্ধনদশা। বিবেকজ্ঞান লাভ হলে আত্মার সঙ্গে অনাত্মা প্রকৃতির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। এই বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আত্মা উপলব্ধি করে, সে কর্তাও নয়, ভোক্তাও নয়, শুধুমাত্র দ্রষ্টাচৈতন্য। এখানে সে পুরুষরূপে বা চিৎস্বরূপে অবস্থান করে, আর এই অবস্থানের নামই আত্যন্তিক দুঃখমুক্তি অর্থাৎ মোক্ষাবস্থা। সাংখ্য-যোগ দার্শনিকগণের মতে মোক্ষাবস্থা অনাবিল সুখ বা আনন্দের অবস্থা নয়।

মোক্ষের প্রশ্নে মীমাংসা দর্শন প্রাচীন ও নব্য এই দুই ধারায় বিভক্ত। প্রাচীন মীমাংসা দার্শনিকগণ ‘ত্রিবর্গ পুরুষার্থ’ এবং নব্য মীমাংসা দার্শনিকগণ ‘চতুর্বর্গ পুরুষার্থে’র  কথা উল্লেখ  করেন। প্রাচীন মীমাংসা দর্শনে মোক্ষকে পরমপুরুষার্থ বলে স্বীকার না করলেও নব্য মীমাংসা দর্শনে মোক্ষকেই পরমপুরুষার্থ বলে স্বীকার করা হয়। প্রাচীন মীমাংসা দর্শন অনুসারে জীবের পরমলক্ষ্য বৈদিক যাগ-যজ্ঞাদির দ্বারা স্বর্গলাভ করে অনন্ত সুখ ভোগ করা। আর নব্যপন্থীরা মনে করেন, নিষ্কামভাবে বেদবিহিত কর্মের মাধ্যমেই আত্মার মোক্ষলাভ সম্ভব। আত্মা মোক্ষ অবস্থায় সুখ-দুঃখের অতীত এক অচেতন সত্তা হিসেবে বিরাজ করে।

কৈবলাদ্বৈত বৈদান্তিক শঙ্করাচার্য এবং বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজ মোক্ষ প্রশ্নে ভিন্ন মত পোষণ করেন। শঙ্করের  মতে, জীবই ব্রহ্ম, জীবাত্মাই পরমাত্মা এবং জীব ও ব্রহ্ম অভেদ। এই অভেদ জ্ঞানই মুক্তি। কিন্তু জীব অজ্ঞানতাবশত নিজেকে ভিন্ন মনে করে। আর এটিই হচ্ছে জীবের ‘বন্ধনদশা’। প্রকৃত জ্ঞানের মাধ্যমে জীবের ব্রহ্মোপলব্ধি হয় এবং পুনর্জন্মরোধে জীব পরমাত্মার সঙ্গে একাত্ম হয়ে সচ্চিদানন্দরূপে বিরাজ করে। রামানুজের মতে, জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার ভেদাভেদ সম্পর্ক। অবিদ্যার কারণে জীব নিজেকে ঈশ্বর থেকে স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন মনে করে এবং এভাবেই ‘বন্ধনদশায়’ আবদ্ধ হয়। মোক্ষ অবস্থায় জীব ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করে ঈশ্বরের মধ্যেই আশ্রয় গ্রহণ করে। তাই মোক্ষ হচ্ছে ঈশ্বরের সান্নিধ্য এবং ঈশ্বরে আশ্রিত হওয়া। মোক্ষলাভের জন্য শুধু জ্ঞান নয়, ভক্তিরও একান্ত প্রয়োজন।  [মালবিকা বিশ্বাস]