মেঘনাদবধ কাব্য

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৪৮, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

মেঘনাদবধ কাব্য  দুখন্ড ও নয় সর্গে রচিত মাইকেল মধুসূদন দত্তের (১৮২৪-৭৩) মহাকাব্য। প্রথম খন্ড ১৮৬১ সালের জানুয়ারি মাসে এবং দ্বিতীয় খন্ড একই বছরের আগস্ট মাসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। প্রথম সংস্করণগুলিতে মধুসূদন দত্তের নিজের নকশা করা একটি প্রতীকী চিত্র ছিল। এ চিত্রে ভারতের প্রতীক হিসেবে ছিল হাতির ছবি, ইউরোপের প্রতীক হিসেবে সিংহের ছবি, মধুসূদনের নিজের প্রতিভার প্রতীক সূর্য এবং মহাকাব্যের প্রতীক হিসেবে শতদল; অর্থাৎ ভারত, ইউরোপ এবং নিজের প্রতিভার সমন্বয়ে এ মহাকাব্য। এ চিত্রের নিচে ছিল একটি সংস্কৃত শ্লোক—শরীরম্ বা পাতযেযম্ কার্য্যম্ বা সাধযেযম্ (আমি যা করার জন্যে সংকল্প করেছি, তাতে ব্যর্থ হওয়ার বদলে আমি বরং মৃত্যুকে বরণ করব)। এ প্রতীকী চিত্র থেকে বোঝা যায়, মধুসূদনের লক্ষ্য ছিল এমন একটি কাব্য রচনা করা যাতে ভারতবর্ষ এবং ইউরোপের মহাকাব্যের ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটবে এবং যা স্থায়ী ধ্রুপদী সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করবে। এ কাব্যের মাধ্যমে তিনি তাঁর এ স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেন। কাব্য রচনার ক্ষেত্রে তিনি ব্যাস, বাল্মীকি, হোমার, ভার্জিল, দান্তে, মিল্টন এবং তাসোকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং তাঁর এ কাব্য পুরোপুরি তাঁদের মান অর্জন করেছে। কেবল উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের গোটা আধুনিক সাহিত্যেই তাঁর এ কাব্যের সমকক্ষতা কেউ লাভ করতে পারেননি।

মহাকাব্য রচনার জন্যে মধুসূদন অমিত্রাক্ষর ছন্দ নামে এক নতুন বাংলা ছন্দ নির্মাণ করেন। এ ছন্দে তিনি মধ্যযুগের চৌদ্দ মাত্রার পয়ার ছন্দ বজায় রেখেছেন, কিন্তু যতির সুনির্দিষ্ট স্থান বদল করে পঙ্ক্তির যেকোনো জায়গায় রাখার স্বাধীনতা নিয়েছেন, আর সেসঙ্গে নিয়েছেন এক পঙ্ক্তি থেকে আরেক পঙ্ক্তিতে অবলীলায় যাওয়ার প্রবহমানতা।

তিনি তাঁর মহাকাব্যের পরিকল্পনা করেছেন সুচিন্তিতভাবে। এর ঘটনাপ্রবাহে সময় এবং স্থানের সমন্বয় ঘটিয়েছেন এবং আগের ঘটনা নিয়ে এসেছেন অতীতকে প্রতিফলিত করার (ফ্লাশব্যাকের) মাধ্যমে। তিনি তাঁর বিষয়বস্ত্ত নিয়েছেন বাল্মীকির রামায়ণ থেকে, কিন্তু দৃষ্টির কেন্দ্রে রেখেছেন রামচন্দ্র এবং তাঁর সহযোগীদের হাতে রাবণের পরাজয়, বিশেষ করে চতুর্থ সর্গে বিভীষণের সহায়তা নিয়ে লক্ষমণের হাতে রাবণের পুত্র মেঘনাদের বধের দিকে। বাল্মীকির রামায়ণে দেখানো হয়েছে লক্ষ্মণ ও তাঁর বানরবাহিনীর আক্রমণে প্রহরীদের বিপর্যস্ত হতে দেখে যজ্ঞ ত্যাগ করে সম্মুখ সমরে লিপ্ত হয়েছিলেন মেঘনাদ, সেখানেই লক্ষ্মণের হাতে তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু মধুসূদন এ ঘটনাকে এভাবে না দেখিয়ে নিরস্ত্র মেঘনাদ যখন অপরাজেয় হওয়ার জন্যে অগ্নির পূজো করছিলেন, তখন লক্ষ্মণের হাতে অন্যায়ভাবে নিহত হওয়ার দৃশ্য অঙ্কন করেন। এর মাধ্যমে রাক্ষসদের ট্র্যাজিক বীরে পরিণত করার যে-সংকল্প মধুসূদন নিয়েছেন, তা সার্থক হয়। এর সঙ্গে তুলনীয় হোমারের ইলিয়াড কাব্য যেমন করে গ্রিকদের হাতে ট্রয়ের পতন দেখানো হয়েছে।

তাঁর এ মহাকাব্যে গ্রিক প্রভাব আরো লক্ষ করা যায় উপমা ব্যবহারে এবং দেবতাদের বিভিন্ন ভূমিকা থেকে। এ মহাকাব্যে যে শৈব-প্রভাব দেখা যায়, তা এসেছে সম্ভবত কৃত্তিবাসের রামায়ণ থেকে, যাতে রাবণকে শিবের উপাসক হিসেবে দেখানো হয়েছে। তাছাড়া  দেবতাদের মানুষের মতো করে উপস্থাপনের ব্যাপারটিও (যেমন, দ্বিতীয় সর্গে দুর্গা তাঁর স্বামীকে তাঁর নিজের মতে আনার জন্যে তাঁর সৌন্দর্যকে কাজে লাগান) বিশেষভাবে গ্রিক প্রভাবজাত।

খ্রিস্টধর্মের একজন বিশ্বাসী ব্যক্তি হিসেবে মধূসূদনের পাপবোধ বেশ প্রবল ছিল এবং তিনি মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট-এ কেবল তাঁর বাংলা অমিত্রাক্ষরের আদর্শ দেখতে পাননি, বরং সেসঙ্গে খুঁজে পেয়েছেন নৈতিকতার আদর্শ। যেমন তাঁর ইংরেজি চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘আমি রাম এবং তাঁর বানরবাহনীকে ঘৃণা করি; রাবণের ধারণা আমার ভাবনাকে উস্কে দেয় এবং আমার কল্পনাকে প্রজ্বলিত করে।’ তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে রাক্ষসদের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও শেষ পর্যন্ত দেবতাদের কার্যকলাপ তাঁকে মেনে নিতে হয়েছে, যেমন সীতাকে অপহরণ করার কর্মফলে রাবণ নিজেই নিজের পতন ডেকে এনেছেন।

অন্যান্য সফল ধ্রুপদী সাহিত্যের মতো মেঘনাদবধ কাব্যকে প্রতিটি প্রজন্ম নতুন করে ব্যাখ্যা করতে পারে। কারো কাছে রাবণ এবং মেঘনাদ হলেন ‘বঙ্গীয় রেনেসাঁসে’র মানবিক আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। অন্যরা আবার একে মধুসূদনের হাতে মেঘনাদবধের মধ্য দিয়ে ঐতিহ্যিক মূল্যবোধ বিনষ্ট হওয়ার বৈপ্লবিক দৃষ্টান্ত লক্ষ করেছেন, এমনকি, মার্কসীয় বার্তাও। মেঘনাদবধে আরো একটা লক্ষণীয় বিষয়-এতে লঙ্কার সৌন্দর্য যেভাবে দেখানো হয়েছে, তাতে প্রতিফলিত হয়েছে উপমহাদেশের চিরকালীন সংস্কৃতি ও ধর্ম, মধুসূদন যাকে  আখ্যায়িত করেছেন-‘আমাদের পূর্বপুরুষদের ঐশ্বর্যমন্ডিত পৌরাণিক কাহিনী’ বলে।  বর্তমানে বহু প্রাচীন ঐতিহ্য বিশ্বায়িত গণসংস্কৃতির মুখে হুমকির সম্মুখীন, এসময়ে তাঁর এ মহাকাব্য একটা ট্র্যাজিক চেতনা জাগিয়ে তোলে। সর্বোপরি মেঘনাদবধ কাব্য  মধুসূদনের অসাধারণ আবেগঘন, উচ্ছ্বাসপূর্ণ, রসোজ্জ্বল, মননশীল এবং শেষ পর্যন্ত আত্মঘাতী ব্যক্তিত্বের অনুকরণীয় প্রতিফলন। মধুসূদনের মন্তব্য- ‘একজন প্রবল সাহিত্যিক বিপ্লবী’। তাঁর এ দুঃসাহসী ধ্রুপদী রচনা বাংলাদেশ, ভারত এবং তার বাইরে প্রতিটি নতুন প্রজন্মকে বিস্মিত করবে বারবার।  [উইলিয়াম র‌্যাডিচি]