মূকাভিনয়

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৪৭, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

মূকাভিনয়  সংলাপহীন অভিনয়। বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে এতে বক্তব্য প্রকাশ করা হয়। ব্যাপক অর্থে মূকাভিনয় হচ্ছে বাচিক ব্যতিরেকে আঙ্গিক, আহার্য ও সাত্ত্বিক কলাযোগে মোহমায়া (Illusion) সৃষ্টির মাধ্যমে দর্শকদের সামনে কোনো বিষয় শিল্পসম্মতভাবে উপস্থাপন করা। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Mime বা Pantomime।

বাংলাদেশে মূকাভিনয়চর্চা শুরু হয় মূলত স্বাধীনতা উত্তরকালে। তার আগে কোথাও কোথাও গ্রাম্য মেলা, পূজাপার্বণ, ধর্মীয় উৎসব এবং বিভিন্ন লোকাচারে বিক্ষিপ্তভাবে দেহভঙ্গিমার মাধ্যমে নির্বাক অভিনয়ের প্রচলন ছিল। এছাড়া কোনো কোনো লোকসঙ্গীতের উপস্থাপনা, লাঠিখেলা এবং কুস্তির লড়াইয়েও এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

বাংলাদেশে মূকাভিনয়চর্চাকে দুটি পর্বে ভাগ করা যায়: ১৯৭৫-৮৮ এবং ১৯৮৯ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত। আমেরিকান শিল্পী Adam Darius ১৯৭৫ সালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে প্রথম মূকাভিনয় প্রদর্শন করেন। তখন থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের মঞ্চে একক মূকাভিনয় প্রদর্শিত হয়েছে। সেগুলি ছিল স্বল্প সময়ব্যাপী এবং সংখ্যায়ও কম। শিল্পীর পোশাকের ধরন প্রায় একই রকম হতো কালো রঙের অাঁটসাট আচ্ছাদন এবং মুখে সাদা রংয়ের প্রলেপ। বিষয়বস্ত্ত ছিল অত্যন্ত হালকা ও বিনোদনধর্মী। এ পর্বে সৃজনশীল ধ্যান-ধারণা বিশেষ একটা ছিল না। তবে নানা রকম সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তখন যে কয়েকটি ভাল প্রদর্শনী হয়েছে সেগুলির মধ্যে রয়েছে জন্ম থেকে মৃত্যু, বালক ও পাখি, প্রজাপতি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ফটোগ্রাফার, ঔষধ বিক্রেতা, বখাটে ছেলের পরিণতি, রিকশাওয়ালা, মাছ ধরা ইতাদি। এগুলিতে ক্যারিকেচার এবং অহেতুক হাস্যকৌতুকের স্থলে ক্ষেত্রবিশেষে বিষয়ের গভীরতা প্রকাশ পেয়েছে।

১৯৮৯ সাল থেকে একক অভিনয়ের পাশাপাশি দলগত অভিনয়ের ধারাও প্রচলিত হয়। এ ক্ষেত্রে ‘ঢাকা প্যান্টোমাইম’ পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে। ১৯৮৯ সালের ২৩ অক্টোবর প্রতিষ্ঠার পর থেকে দলটি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একক ও দলগত মূকাভিনয় পরিবেশন করে এ শিল্পকে জনপ্রিয় করে তোলে। বিষয়বস্ত্তর প্রয়োজনে এতে তখন একাধিক শিল্পীর সমাবেশ ঘটে। রূপসজ্জা, পোশাক, আলো, মিউজিক, মঞ্চ ব্যবহার ইত্যাদি ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসে। আলো ও মঞ্চসজ্জার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সাধারণ রূপসজ্জা, মুখোশের ব্যবহার ইত্যাদিতে নতুন সংযোজন ঘটে। ছোট ছোট স্কেচের পরিবর্তে একটি বিশেষ ঘটনা বা কাহিনীকে উপজীব্য করে ৩০ থেকে ৫০ মিনিট ব্যাপী অভিনয় উপস্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।

মূকাভিনয়

১৯৯০-এর পর থেকে ঢাকার মঞ্চে স্কেচ ও মূকনাটক (Mimodrama) পাশাপাশি প্রদর্শিত হতে থাকে। এসব প্রযোজনায় আধুনিক মূকাভিনয়ের রীতিনীতি ও কৌশল প্রয়োগে নানারূপ গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়াস দৃষ্ট হয়। বিশেষত, কারিগরি দিকসমূহের পরিবর্তনের মাধ্যমে মূকাভিনয় চর্চায় নতুন বিশেষত্ব আনা হয়; বিষয়বস্ত্ত চয়ন, নির্মাণ ও প্রদর্শন গুরুত্ব পায়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, মহিলা সমিতি মিলনায়তন, গাইড হাউজ মিলনায়তন, ব্রিটিশ কাউন্সিল, জার্মান কালচারাল সেন্টার ইত্যাদি মঞ্চ এবং শহীদ মিনারের পাদদেশে প্রদর্শিত হয় ঢাকা প্যান্টোমাইমের প্রযোজনাসমূহ। সেসবের মধ্যে মানব সভ্যতা, মানব ও প্রকৃতি,  ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা, নদী পাড়ের জীবন, মাদকাসক্তি, আর নয় হিরোশিমা, স্বাধীনতা সংগ্রাম, জীবনযুদ্ধ ও শান্তি, জীবন সংগ্রামে নৈতিকতা, নারী নির্যাতন, দুঃস্বপ্ন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত কর্মশালা প্রযোজনাসমূহের মধ্যে রয়েছে সোনার কাঠি ও রূপার কাঠি, আলী বাবা ও চল্লিশ চোর, সাত ভাই চম্পা ইত্যাদি। এসব প্রযোজনার সব কটিই দলগত এবং অধিকাংশই দীর্ঘ সময়ব্যাপী পূর্ণাঙ্গ উপস্থাপনা। এগুলিতে মানুষের জীবনসংগ্রাম, ইতিহাস ও সামাজিক সমস্যা  তুলে ধরা হয়।

১৯৯১ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী এবং ঢাকা প্যান্টোমাইম যৌথভাবে প্রথমবারের মতো আয়োজন করে ‘মূকাভিনয় উৎসব-৯১’। দুটি বিদেশী দলের অংশগ্রহণে মূকাভিনয় প্রদর্শনী ছাড়াও একাডেমী মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় মূকাভিনয় বিষয়ক প্রথম সেমিনার। অন্যদিকে এশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে বাংলাদেশের মূকাভিনয় দলও দেশীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরার সুযোগ পায়। নানা রকম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও মূকাভিনয়চর্চা এখন ব্যক্তিগত ভুবন থেকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে।  [জিল্লুর রহমান জন]