মুসলিম লিপিকলা

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৪:৩৫, ৫ মার্চ ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

মুসলিম লিপিকলা  স্বাধীন সুলতানি আমলে বাংলা শিল্পকলা ও স্থাপত্যের সব কয়টি শাখায় গৌরবময় অবদান রেখেছে। হস্তলিপিকলায় (calligraphy) বাংলায় মুসলিমদের অবদান সবচেয়ে মৌলিক এবং অনন্য বলেই প্রতীয়মান হয়।

বাংলায় লিপিকলার প্রকাশ বিভিন্ন সৌধ যেমন, মসজিদ, মাদ্রাসা ও সমাধির দেওয়ালে প্রাপ্ত শিলালিপিতে সীমাবদ্ধ। বৈরী প্রকৃতি ও রাজনৈতিক গোলযোগের কারণে লিপিকলার পান্ডুলিপির কোন নমুনা টিকে থাকেনি।

ব্রাহ্মলিপি (খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৩ শতক), মহাস্থানগড়

সূচনাকাল থেকেই বাংলায় লিপিকলার শৈলী গঠন-চাতুর্যে ও বিন্যাসের সূক্ষ্মতায় বৈশিষ্ট্যময় হয়ে ওঠে। এসব বৈশিষ্ট্যের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় বিহারের বড়ি দরগাহ-র শিলালিপিতে। বিহার তখন বাংলার অংশ ছিল। দিল্লির কুতুব মিনার ও কুওয়্যত-উল-ইসলাম মসজিদে শিলালিপির সঙ্গে এ লিপি শৈলীর সাধারণ মিল থাকলেও একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, বড়ি দরগাহ-র শিলালিপির লিপিকরদের প্রবণতা রয়েছে কোন কোন হরফকে তির্যক নিম্নাভিমুখী করে সেগুলির প্রান্তদেশকে অলঙ্কৃত করা এবং কিছু খাড়া হরফের শীর্ষদেশ রেখাযুক্ত করে এমন একটি আকার দেওয়া, যাকে বলা যায় এক ধরনের ফাঁস, যা গোটা শিলালিপির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। অলঙ্করণের এ প্রবণতাগুলি সাফল্যের সঙ্গে বিকশিত ও সমৃদ্ধতর করে বাংলার পরবর্তীকালের লিপিকলামূলক শিলালিপিকে আরও নিটোল ও নিখুঁত রূপ দান করা হয়।

বাবরগ্রাম মুর্শিদাবাদ লিপি, আলাউদ্দিন হোসেন শাহ , ১৪৯৮ খিস্টাব্দ

পশ্চিম দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুরের মসজিদের পেছনের দেওয়ালে প্রাপ্ত ৬৪৭ হিজরির (১২৪৯ খ্রি) শিলালিপিসমূহে হরফগুলি অত্যন্ত মনোমুগ্ধকরভাবে ঈষৎ অলঙ্করণে লেখা হয়েছে, আর এ রীতি বাংলার পরবর্তীকালের তুগরা শৈলীতে অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যময় ও লক্ষণীয় হয়ে ফুটে উঠেছে। অপূর্ব সুন্দর নাস্খ লিপিকলার একাধিক নমুনা বিহারে প্রাপ্ত ৭০১ হিজরির(১৩০১ খ্রি) এক শিলালিপিতে পাওয়া গেছে। এ লিপিতে বাংলার সুলতান ফিরুজ শাহের নাম লেখা রয়েছে। এখানে কোন কোন খাড়া অক্ষরের অলঙ্কৃত শীর্ষদেশগুলি ফাঁসবন্ধনী (ligate) দিয়ে সংযুক্ত করার প্রবণতা চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে, যা বরী দরগায় প্রাপ্ত শিলালিপিগুলিতে লক্ষ্য করা যায়। দেখা যায় যে, সংশ্লিষ্ট লিপিকলাবিদ উল্লম্ব ও বাঁকা রেখা অঙ্কনে অত্যন্ত পারদর্শিতা ও সামর্থ্যের পরিচয় দিয়েছেন। আর হরফের অাঁক ও বাঁকগুলি অত্যন্ত নিখুঁত ও সুচারু এবং চিরাচরিত বিধিনিষেধের নিগড় থেকে একান্তভাবে মুক্ত। এই লিপিকলার সঙ্গে সমসাময়িকালে উৎকীর্ণ দিল্লির আলাই দরওয়াজা-র শিলালিপির তুলনা করলে এ সত্যই উদঘাটিত হয় যে, বাংলার হস্তলিপিকলার মূল সুর ছিল অপূর্ব পরিশীলন ও সূক্ষ্মতা; পক্ষান্তরে দিল্লির এ কলার লক্ষ্য ছিল, বিশেষ করে, প্রাথমিক পর্যায়ের সুলতানদের আমলে বলিষ্ঠতা ও জৌলুষ।

বাংলার ফিরুজশাহী আমলে ৭১৩ হিজরির(১৩১৩ খ্রি) আরেকটি শিলালিপি ত্রিবেণীতে জাফর খানের সমাধির উত্তর দিকে পাওয়া গেছে। এ শিলালিপিতে এমন এক ধরনের লিপিকলার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় যাতে বোঝা যায়, সেখান থেকেই তুগরা লিপিকলার একটি শাখা হিসেবেই সেটি আরও বিকশিত হয়ে উঠেছে। এ ধরনের তুগরা লিপিকলার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো সমাকার বিন্যাসে হরফের খাড়া অলঙ্করণ, নিয়মিত ধাঁচ এবং ভিত্তিতে অনুভূমিক হরফগুলির গুচ্ছবিন্যাস। ভিন্ন অবস্থানে থাকা আরবি হরফ ফি (fi) ও বিচ্ছিন্ন কাফ (kaf) হরফ দুটিকে খাড়া একাধিক দন্ড বা খাড়া রেখা বরাবর বসানো হয়েছে। বিষয়টি লক্ষ্য করার মতো।

ত্রিবেণীতে ফিরুজশাহী শিলালিপিশৈলীর যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, সেটি শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ এর আমলের এক শিলালিপিতে নিটোল হয়ে উঠেছে। এর নমুনা কলকাতার পূর্ব উপকণ্ঠের একটি আধুনিক মসজিদে পাওয়া গেছে। এ শিলালিপির ভিত্তিতে হরফগুলি কার্যত প্রায় ছোট ছোট বৃত্তের আকার নিয়ে শিল্পিজনোচিতভাবে সেগুলিকে একত্রে পাকানো হয়েছে। অতঃপর খাড়া অক্ষরগুলির অলঙ্করণের কাজ অত্যন্ত চমৎকারভাবে একসারি বর্শার আকারে বিন্যস্ত করা হয়েছে। স্বতন্ত্র ফি ও বিচ্ছিন্ন কাফ কোন কোন খাড়া হরফের দাঁড় বরাবর আড়াআড়ি বিন্যস্ত করার কারণে আকৃতি অত্যন্ত মনোহর হয়ে উঠেছে। তাই এ শিলালিপির লিপিকলাকে পূর্ণ বিকশিত তুগরা শৈলীর অন্তর্ভুক্ত বলে বর্ণনা করা যায়।

সোনারগাঁও লিপি, নুসরত শাহ, ১৫২২ খ্রিস্টাব্দ

পান্ডুয়ার আদিনা মসজিদ এ প্রাপ্ত ৭৭৬ হিজরির (১৩৭৪-৭৫ খ্রি) শিলালিপিতে যে হস্তলিপিকলার নিদর্শন পাওয়া যায় তাকে বাংলার লিপিকলা বিকাশে এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখা যায়। এ শিলালিপির অসাধারণ লিপিকলা দেখে ব্লকম্যান এতই মুগ্ধ হন যে তিনি মন্তব্য করেন, ‘আমার দেখা লিপিগুলির মধ্যে এগুলিই সবচেয়ে সুন্দর। এর হরফগুলি সুন্দর এবং এর ঘষা ছাপগুলি আমি যখনই দেখেছি, তখনই ভীষণ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।’

এ লিপিকলার দুটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা মনোযোগ আকর্ষণের দাবি রাখে। প্রথমত, সযত্নে টানা পার্শ্ব তির্যক রেখাগুলি দিয়ে কোন কোন হরফের খাড়া রেখাগুলির অলঙ্করণ দেখতে তীরের ফলার মতো মনে হয়। আর এ থেকে তুগরা রীতির ‘তীরধনু’ জাতের লিপির কিছু বৈশিষ্ট্যের আভাস মেলে। শেষোক্ত এ রীতিটি বাংলায় পরবর্তীকালে বিকাশ লাভ করে।

দ্বিতীয়ত, পরবর্তী ফি, যা পূর্ববর্তী শিলালিপিতে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে, ভাসমান হাঁসের মতো কোন কোন হরফের খাড়া দন্ডের সম্মুখে সুন্দরভাবে অঙ্কন করা হয়েছে। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি হাঁসের মতো বৈচিত্র্যে বর্ণিত তুগরা রীতির প্রধান বিষয়বস্ত্ত স্থির করে।

একই মসজিদের আরেকটি শিলালিপিতে লিপিকলার একই রকমের চমৎকার শৈলী লক্ষ্য করা যায়। এ শিলালিপির প্যানেলের শীর্ষসারিটি অনবদ্য কুফিক রীতির হরফে লেখা। এর থেকে মনে হয় যে, বাংলার লিপিবিশারদগণ দক্ষতার সাথে কুফিকলিপি লিখতে পারতেন। তবে এ যাবৎকালে পরিদৃষ্ট কুফিক লিপিতে লেখা শিলালিপি বলতে এটিই একমাত্র নমুনা যা বাংলায় পাওয়া গেছে।

শিলালিপি (১৫৮১-৮২ খিস্টাব্দ), মাসুম খান কাবুলি, চাটমোহর ,পাবনা

সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদের শাসনামলে বালিয়াঘাটায় ৮৪৭ হিজরিতে (১৪৪৩ খ্রি) শিলালিপি পাওয়া গেছে। ধৈর্যশীল পরীক্ষা-নিরীক্ষার সফল ফল ছিল এ শিলালিপির লিপিকলা। নাসিরুদ্দীন মাহমুদের সময় থেকেই শুরু হয় বাংলায় ইলিয়াসশাহী শাসনের দ্বিতীয় পর্যায়। এ শিলালিপিটি সরাসরি ঐ সময়ের কথা বলে যখন বাংলায় লিপিকলা তার বিকাশের শিখরে পৌঁছে।

এই শিলালিপির পূর্ণ বিকশিত তুগরা রীতিতে অত্যন্ত সূক্ষ্ম, জটিল ও শিল্পময় ধাঁচ পরিলক্ষিত হয়। এখানে খাড়া হরফগুলির খাড়া টান বা দন্ডাকার অংশগুলি আরও উপরের দিকে প্রলম্বিত করে অত্যন্ত মনোহরভাবে এক সারিতে বিন্যস্ত করা হয়েছে এবং অন্যদিকে লিপির মূল পাঠ্যাংশকে ভিত্তিমূলে যথাশৃঙ্খলায় বিন্যস্ত করা হয়েছে। গোলাকার হরফগুলিকে আরও কিছুটা মোচড় দিয়ে সেগুলি দিয়ে ছোট ছোট বৃত্তের আকার দেওয়া হয়েছে। বিষয়বস্ত্ততে পার্থক্য থাকার কারণে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে হরফগুলির আকার দেওয়া হয়েছে। এ পার্থক্যটুকু ব্যতিরেকে অন্যান্য ক্ষেত্রে এটি ছিল বাংলায় তুগরা লিপিকলার আদর্শ নকশা।

৮৭৮ হিজরিতে (১৪৭৪ খ্রি) সুলতান শামসুদ্দীন ইউসুফের শাসনামলের একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে। এতে ‘তীরধনু’ শৈলীর তুগরা রীতির লিপি বিকাশের এক সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের বিষয় লক্ষ্য করা যায়। তবে এ ‘তীরধনু’ রীতির তুগরা হস্তলিপিকলার নিটোল ও নিখুঁত রূপ অর্জিত হয় দ্বিতীয় সাইফুদ্দীন ফিরুজ শাহের আমলে (৮৯৩ হি/১৪৮৭ খ্রি)। মালদা জেলার কাছে কাটরা মসজিদের শিলালিপিটি তুগরা হস্তলিপিকলার ‘তীরধনু’ রীতির এক নিখুঁত নমুনা বলা যায়।

শিলালিপি (১৬৭৪-৭৫ খিস্টাব্দ), সম্রাট আওরঙ্গজেব, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর

বাংলায় কমপক্ষে পাঁচ ধরনের তুগরা লিপির বিকাশ ঘটে। এগুলি হলো অলঙ্কারহীন তুগরা, বিচ্ছিন্ন ‘কাফ’ ও ‘ইয়া’ বর্ণযুক্ত তুগরা, খাড়া হরফের দন্ডগুলির ঊর্ধ্বে ঝুলন্ত (বিচ্ছিন্ন) ‘হা’ ও ‘ইয়া’যুক্ত তুগরা, হাঁসের মতো তুগরা এবং এগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ‘তীরধনু’ তুগরা। এ হস্তলিপিকলা বিকাশের সর্বশেষ পর্যায়ে, উল্লিখিত সকল তুগরা হস্তলিপি শৈলীর বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলি সমন্বিত হয়ে এক নতুন ধরনের সরল অথচ অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক এক তুগরা রীতির সৃষ্টি হয়। এই রীতির নমুনা হোসেনশাহী আমলের বিভিন্ন শিলালিপিতে লক্ষ্য করা যায়। বাংলায় বিকশিত তুগরা লিপির কোন তুলনা গোটা মুসলিম বিশ্বে নেই বলেই অনুমিত হয়।

তুগরা রীতির বিভিন্ন উপরীতি গড়া ছাড়াও বাংলার হস্তলিপিকরগণ সর্বদাই সরল অথচ অত্যন্ত চমৎকার নসখ ও সুলস রীতির লিপিতে তাদের পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছেন। ৮৮৯ হিজরির (১৪৮৭ খ্রি) এক শিলালিপি গৌড়ের গুনমন্ত মসজিদ এ পাওয়া গেছে। এটি সর্বোচ্চ মানের নসখ লিপিতে লেখা।

বাংলায় হোসেনশাহী আমলের শেষের দিকে সামাজিক-রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় শিল্পকলামূলক কার্যকলাপেও অবক্ষয় নেমে আসে। বাংলায় স্বল্পকাল স্থায়ী আফগান আধিপত্যের আমলে হস্তলিপিকলা উদ্দীপনা লাভ করে বলেই মনে হয় এবং এ শিল্পগৌরবের সর্বশেষ শিখাটি কিছুকালের জন্য প্রজ্জ্বলিত থাকতে দেখা যায় ৯৬৭ হিজরির (১৫৫৯ খ্রি) একটি শিলালিপিতে। এটি ছিল গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহের আমলের। অতঃপর বাংলা তার স্বতন্ত্র পরিচয় হারিয়ে ফেলে। মুগল শাসনের অধীনে আসার পর বাংলার লিপিকরগণ মুগল সাম্রাজ্যের রাজধানীতে অনুসৃত রীতির অনুকরণ করতে শুরু করেন।  [পি.আই.এস মুস্তাফিজুর রহমান]